Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
দুয়ারে দোল: আড্ডা

রঙের ঘোর নিয়েই দুপুর গড়িয়ে নামত বিকেল

বসন্তের হাওয়া বড় অবাধ্য। কোনও বাগ মানে না। এলেমেলো সেই বাতাসে উড়তে থাকে স্মৃতির পাতা। কত কথা, কত গল্প, কত আড্ডা।সময়টা আটের দশক। দোলের সকালে নবদ্বীপের চার বন্ধু মিলে পাড়ি দিতেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে। দীর্ঘ পথ উজিয়ে এক বার বিদ্যানগর, তো পরের বার বাবলারি।

আড্ডা আজও আছে। বদলেছে রং। ফাইল চিত্র

আড্ডা আজও আছে। বদলেছে রং। ফাইল চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
নবদ্বীপ ও বহরমপুর শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৭ ০১:০৪
Share: Save:

বসন্তের হাওয়া বড় অবাধ্য। কোনও বাগ মানে না। এলেমেলো সেই বাতাসে উড়তে থাকে স্মৃতির পাতা। কত কথা, কত গল্প, কত আড্ডা।

সময়টা আটের দশক। দোলের সকালে নবদ্বীপের চার বন্ধু মিলে পাড়ি দিতেন শহর ছেড়ে অনেক দূরে। দীর্ঘ পথ উজিয়ে এক বার বিদ্যানগর, তো পরের বার বাবলারি। মাদার, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার নিচে বসে তুমুল আড্ডা, কবিতা, গান। মাঝে মাঝে গ্রামের দু’একজন খুদে সামান্য জোলো রং নিয়ে এসে গায়ে ছিটিয়ে যেত।

শহরের রং উপেক্ষা করে এমন ভাবে গোটা দিন কাটিয়ে দেওয়া মধ্যে বেশ একটা বিপ্লবী ব্যাপার ছিল ‘চেতনা’ গোষ্ঠীর তরুণ কবি সাহিত্যিকদের কাছে। তাঁদের অন্যতম সুব্রত পাল জানাচ্ছেন, সে এক সময় ছিল। প্রত্যেকে অপেক্ষা করতেন এই দোলের সময়টার জন্য।

আরও আগের কথা। সেই সময় রায়বাহাদুর পূর্ণচন্দ্র বাগচীর প্রতাপ ছিল সারা নদিয়া জুড়ে। দোলের সকালে তাঁর বৈঠকখানার আসরে জায়গা পাওয়াই ছিল একটা বড় ব্যাপার। সেখানে থাকতেন বিশিষ্ট জনেরা। আড্ডার মেজাজ ধরে রাখত কালোয়াতি গান। সঙ্গে দফায় দফায় খাওয়াদাওয়া।

কেন্দ্র সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী দীপক দাশগুপ্ত জানান, সেকালে প্রায় সব বাড়িতেই দোলের দিনে আড্ডার আসর বসর। দোলের আবীর নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের হুল্লোড় চলত যৌথ পরিবারগুলোতে। ওই একটি দিনই কেবল কুলদেবতা রাধাগোবিন্দকে ছুঁতে পারতেন সবাই। আবীর দিতে হত বিগ্রহের পায়ে। দীপকবাবুর কথায়, ‘‘বাড়িতে তখন জোর আয়োজন চলছে। গামলায় ঢালা হত ফাগ-আবিরে সুগন্ধি আর অভ্র। বেলা বাড়লেই এসে পড়তেন বাবাদের বন্ধুবান্ধব। শুরু হতো হইহই আড্ডা। গুরু গম্ভীর বাবা কাকারাও ওই একটি দিন বয়স কমিয়ে যেন আমাদের মতো হয়ে যেতেন।’’

ছোটরাও দলবেঁধে চলে যেত বন্ধুদের বাড়ি। সেখানে গোপন আড্ডায় শুধু গুপ্ত আক্রমণের ছক। রং-মাখা হাতেই মুড়কি, ছোলা, চিনির রঙিন মঠ কিংবা রসগোল্লা উঠে যেত মুখে। পরিচিত কাউকে চ্যাংদোলা করে রং-গোলা জলে চৌবাচ্চায় ফেলা কিংবা
দোতলার বারান্দা থেকে আচমকা রঙের বালতি উপুড় করা ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার।

বিকেলে আর কোনও রং-হামলা নয়, দুধ-সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি জড় হতেন বাড়ির সকলে। শুকনো আবির দেওয়া হত বড়দের পায়ে, ছোটদের কপালে। তারপর বাড়ির ছেলেমেয়ে, বাবা-কাকাদের গানবাজনার অনুষ্ঠান। যার মহড়া চলেছে সেই সরস্বতী পুজোর পর থেকে। দোলের পরেও বেশ কিছু দিন পর্যন্ত বাড়িতে ঝাঁট দিলে ধুলোর সঙ্গে জড়ো হত আবীর।

দোলের মরসুমে বহরমপুরের প্রায় প্রতিটি পাড়াতে বৈঠকী মজলিস বসত। সেখানে পাড়ার সকলেই যোগ দিতেন। বহরমপুরের প্রবীণ নাগরিক সাবিত্রীপ্রসাদ গুপ্ত জানাচ্ছে, দোলের সন্ধ্যায় বৈঠকী আড্ডা ছিল বাঁধা। সারা দিন রং খেলার পরে সন্ধ্যায় পাড়ার কোনও মাঠে বা কোনও খোলা জায়গায় গোল করে বসে চলত গান, আড্ডা।

এখন কি তাহলে আড্ডা তার জৌলুস হারিয়েছে? শুনেই রে রে করে উঠছেন বহরমপুরের পিয়াসী দত্ত কিংবা নবদ্বীপের মিলন ঘোষ। তাঁরা জানাচ্ছেন, সময় পাল্টেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গিয়েছএ অনেক কিছুই। তাই বলে আড্ডা কিন্তু বন্ধ হয়নি। আড্ডা ছাড়া আবার দোল জমে নাকি!

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের জমানায় সেই আড্ডার রং কি ঈষৎ ফিকে হয়ে যাচ্ছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Old People Holi Colours
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE