চলছে মহড়া। কান্দির দুর্গাপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
ছত্রিশ বছরের ফারাক। তবু আজও তাঁদের আগের মতোই চিরুনি, আয়না ও প্রসাধনে ভরা ব্যাগটি বগলদাবা করে আটপৌরে শাড়ির আঁচল ঢাকা দিয়ে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয় চুপিসাড়ে। অতীতের মতো এখনও তাঁদের উদ্দেশ্য একটাই— সরকারি অথবা বেসরকারি অনুষ্ঠানে মুসলিম বিয়ের গান অথবা মরমিয়া সুরের মন কাঁদানো জারিগান পরিবেশন করা। বিগত প্রায় সাড়ে তিন দশকে কান্দি-বহরমপুর থানা দু’টির সীমান্ত ঘেঁষা ঝুনকা নদী দিয়ে বিস্তর জল গড়িয়েছে। নদী পাড়ের দুর্গাপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব রাসিনা বেওয়ার ও জীবন্তির বছর পঞ্চাশেকের মহিমা খাতুনের বাইরে যাওয়ার আদলটি একই রয়ে গিয়েছে। আবার একই রকম নয়ও বটে। বিলকুল বিপরীত।
তখন মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর রোষ এড়াতে গোপনীয়তার কৌশল নিতে হত। জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সঙ্গীতকে সম্পৃক্ত করতে হতদরিদ্র পরিবারের হার-না-মানা আনপড় মহিলাদের কৌশল, জেদ আর জীবনযুদ্ধের কাছে অবশেষে হার মেনেছে ধর্মীয় মৌলবাদ। ফলে আমজনতার সামনে সরকারি অথবা বেসরকারি আসরে মুসলিম বিয়ের গীত বা জারিগান পরিববেশন করত্যে পড়শি মুসলিম মহিলাদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সবাইকে তো আসরে অংশ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই গান গাইতে যাওয়ার জন্য আজও চুপিসাড়ে বাড়ি থেকে রাসিনাদের রওনা দিতে হয়। এমন দিনবদলের জন্য রাসিনা, মহিমাদের কম মূল্য চোকাতে হয়নি!
শৈশবে গান বেঁধে, সুর দিয়ে, মনের আনন্দে গেয়েছেনও। দোষ হয়নি তখন। রাসিনার কিশোরী বেলার সুরে মন মজেছিল তাঁর প্রাথমিক স্কুলের রাশভারি শিক্ষক ‘আনন্দ মাস্টার’- এর। তিনি তাই রাসিনাকে গাইতে নাচতে উৎসাহ দিতেন। তখনও সঙ্গীতে দোষ ধরেননি মৌলবাদী মোড়লরা। ফলে রাসিনা, মেহেরুন্নেসা, সাকলেমা, মহিমারা ১১ জনে মিলে গড়ছিলেন মুসলিম বিয়ের গানের মহিলা দল। তাঁরা তখন বিবাহিত। শ্বশুরবাড়ি লাগোয়া দুর্গাপুর, ধলা, জীবন্তি ও লক্ষ্মীনারায়ণপুরে। তত দিনে তাঁদের নাচগানের কিছুটা নাম ছুটেছে। রাজ্য ও কেন্দ্রের লোকসংস্কৃতি দফতরও শীতঘুম কাটিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে।
১৯৮৯ সালে সরকারি দফতর থেকে ডাক পেলেন রাসিনা, মহিমারা। কান্দির হ্যালিফক্স ময়দানে ও বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে তাঁরা নৃত্য-সহযোগে গাইলেন। টনক নড়ল মোড়লদের। নিদান দিলেন, “মুসলমানের ঘরে বৌ-ঝি কিনা হাজার লোকের হাটের মাঝে ধেই ধেই করে নাচছে, গাইছে। ধর্ম, হাদিস, কোরান, বোরখা-আব্রু এ সব বলে কি কিছু নেই! আজ থেকে ওরা একঘরে।” প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। তাই তাঁদের স্বামীরা গেলেন গ্রামের মসজিদে নমাজ পড়তে। সরকারের দেওয়া সুধী প্রধান পুরস্কারে সম্মানিত মহিমা খাতুন বলেন, “আমরা গান গাওয়ায় বাড়ির পুরুষদের মারধর করে মসজিদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল মৌলবাদীরা। ধোপা-নাপিত বন্ধ করেছিল।” তা নিয়ে থানা পুলিশও হয়েছে। প্রহৃত পুরুষদের ভয়, “বাড়ির মেয়েরা গান বন্ধ না করলে গ্রামছাড়া হতে হবে।” স্বামী, শ্বশুর, দেওর মার খেয়েছে, তার উপর এ বার সপরিবারে গ্রামছাড়া করার হুমকি! ফলে গান গাওয়া বন্ধ করার জন্য বাড়ির পুরুষরা চাপ দিলেন। পিছিয়ে আসার বদলে আরও জেদি হয়ে উঠলেন তাঁরা। রাসিনা বলেন, “নাচগানের পোশাক ও প্রসাধনী বগলদাবা করে গোপনে একা বিচ্ছিন্ন ভাবে রাস্তা এড়িয়ে মাঠঘাট ও খেতের উপর দিয়ে গিয়ে আমরা ১১ জন মেয়ে মিলিত হতাম কান্দি-বাহরমপুর রাজ্য সড়কের চেকপোস্টের কাছে। সেখান থেকে বাস ধরে পৌঁছে যেতাম নাচগানের আসরে।”
প্রয়াত খেতমজুর ইয়াসতুল্লা শেখের ঘরণি রাসেনা বেওয়া বলেন, “সুরের হাতছানি, তার উপর সঙ্গীত পরিবেশন করে পাওয়া সাম্মানিকের টাকায় সংসারে সুদিন ফেরা— এই দুইয়ের টানে সাধারণ মেয়ে-বৌ তো বটেই, একদা যাঁদের নিদানে একঘরে হতে হয়েছিল সেই মৌলবাদী মোড়লদের বাড়ির মহিলারাও আজ আমাদের সঙ্গে আমজনতার দরবারে নাচগান করতে চান। তবে অত জনকে তো দলে ঠাঁই দেওয়া অসম্ভব। সবাই তো সে কথা বুঝবে না! তাই তাদের লুকিয়েই গান গাইতে যেতে হয়। মুসলিম বিয়ের গীত ছাড়াও জারিগানের দল গড়েছি।”
সরকারি ও বেসরকারি বহু পুরস্কারে সম্মানিত রাসিনাদের গাওয়া গীতে উঠে এসেছে গ্রাম বাংলার সমাজবাস্তবতা। যেমন,
“এত না সোহাগের বেটি আমার জান কারে বা সুপিবো।
ঐ যে হস্তী সোয়ারে আসছে গো লবাবজান তাকে সুপিবো
লগনে যে দিয়াছে ডালা ভরা গহনা তারে সুপিবো।।
আমার এত না সোহাগের বেটি জান কারে সুপিবো।
কোথায় গেল দরদের বাপজান বেটি সপে যান
কোথায় গেল দরদের বাপজান বেটি সপে যান
কোথায় গেল দরদের মা-ভাই বেটি সপে যান।।
এত না সোহাগের বেটি আমার জান কারে সুপিবো।
ঐ যে যাকে দিয়েছি লাক লাক টাকা দান তারে সুপিবো।
ঐ যে যাকে দিয়েছি আংটি দান তারে সুপিবো।।
এত না সোহাগের বেটি আমার জান কারে বা সুপিবো।”
আর একটি গীতে উঠে এসেছে দাম্পত্য জীবনের প্রেমকথা।
“আমি ঠাণ্ডা জলে বসে স্নান করিব নিরালায় বসে
আমি আয়না দিব চিরুনী দেব গো স্বামীর হাতে
টেরি কেটে আসবে যখন নিরালায় বসে
আমি সাবান দিলাম ছুবা গো দিলাম স্বামীর হাতে
স্বামী স্নান করে আসবে যখন
আমি কাপড় দিলাম গামছা দিলাম স্বামীর হাতে
বাবু সেজে আসবে যখন স্বামী দেখবো নয়নে।।”
ওই সব গীতের মতোই প্রায় নিরক্ষর নিঃস্ব পরিবারের মহিলা গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীতকাররা আজ প্রকৃতই গবেষণার বিষয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy