Advertisement
০৫ মে ২০২৪

দোলের পরেও রঙিন উৎসবের শহর

মন্দিরময় নগরী নবদ্বীপ। উৎসব এখানে যেন শেষ হয়েও হয় না। কুঞ্জভঙ্গের বেদনা মিলিয়ে যায় নতুন উৎসবের অধিবাসে। মন্দিরময় এই জনপদের সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃত চর্চা হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে উৎসবের হাত ধরেই সমৃদ্ধ হয়েছে। উৎসবকে ঘিরেই পুষ্ট হয় স্থানীয় অর্থনীতি। নবদ্বীপের কাছে উৎসবের অর্থ তাই অন্য রকম।

উৎসবে মাতোয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।

উৎসবে মাতোয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০১:৫৮
Share: Save:

মন্দিরময় নগরী নবদ্বীপ। উৎসব এখানে যেন শেষ হয়েও হয় না। কুঞ্জভঙ্গের বেদনা মিলিয়ে যায় নতুন উৎসবের অধিবাসে।

মন্দিরময় এই জনপদের সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃত চর্চা হাজার বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে উৎসবের হাত ধরেই সমৃদ্ধ হয়েছে। উৎসবকে ঘিরেই পুষ্ট হয় স্থানীয় অর্থনীতি। নবদ্বীপের কাছে উৎসবের অর্থ তাই অন্য রকম। দোল শেষ হওয়ার পরে আট দিন কেটে গেলেও এ শহর এখনও দোলের রঙে রঙিন। সকাল সন্ধ্যার বাতাসে ভাসছে গুঁড়ো গুঁড়ো আবির। রাস্তায় যানবাহনের ভিড়কে থমকে দিয়ে আচমকা ঢুকে পড়ছে নগর সংকীর্তনের দল। মুহূর্তের মধ্যে শহরের পিচঢালা পথ যেন বৈষ্ণব ভজনকুঠির নাটমন্দির। সুর আর সুগন্ধে তখন প্রবল গরমেও ভরা বসন্ত।

চৈতন্যধাম নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠে দোল পূর্ণিমার পরেও চলে তৃতীয় দোল, চতুর্থ দোল, পঞ্চম দোল, সপ্তম দোল কিংবা দশম দোল। বৃন্দাবনের বর্ষাণা হোলি, জাওয়াট হোলি বা নন্দগ্রাম হোলির মতো এইসব দোলগুলি স্বমহিমায় উজ্জ্বল। দোলের পরেও এতদিন ধরে দোল ভূ-ভারতে আর কোথাও হয় না। কিন্তু কেন? নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব জানান, নবদ্বীপের দোল সব দিক থেকেই চরিত্রগত ভাবে আলাদা। কারণ সারা দেশ জুড়ে ফাল্গুনী পূর্ণিমার দিনে রাধাকৃষ্ণের দোল পালন করা হলেও নবদ্বীপে সেদিন কেবল গৌরপূর্ণিমা, চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি। তাই কোন মঠ-মন্দিরে দোল খেলা হয় না। মহাপ্রভুর জন্মোৎসবের অঙ্গ হিসাবে পূর্ণিমা সন্ধ্যায় পালন করা হয় অভিষেক বা অনান্য জাতকর্ম। পরের দিন থেকে মন্দিরগুলো বিভিন্ন দিনে পালন করে থাকে মহাপ্রভুর দোল।

যদিও ঠিক কবে থেকে এই ধারাবাহিক দোলের সূচনা তা নিয়ে কোনও পাথুরে প্রমাণ নেই। তবে বিভিন্ন মন্দিরের প্রধানেরা জানান, আড়াইশো থেকে তিনশো বছর ধরে এ ভাবে দোল উদ্যাপিত হয়ে আসছে নবদ্বীপের বৈষ্ণব মঠগুলিতে। এখানেই আর পাঁচ জায়গার সঙ্গে নবদ্বীপের দোল উৎসবের পার্থক্য। ধারাবাহিক এই দোল উৎসবের কারণে মরসুমি বাণিজ্যও চলে দীর্ঘদিন ধরে। কেননা বিভিন্ন মঠ মন্দিরের নিজস্ব দোল উপলক্ষে বিপুল পরিমাণে শিষ্য সমাগম হয়। আবার যাঁরা দোলের ভিড়ে শহরে আসতে পারেন না, তাঁরাও অনেকে এই সময়ে শহরে আসেন।

ধামেশ্বর মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্ব যে বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতির উপর, সেই সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী জানান, মহাপ্রভু মন্দিরে পালিত হয় দশম দোল। পূর্ণিমার দশ দিনের মাথায় এই দোল বলে এর নাম দশম দোল। তিনি বলেন, “দোলের দিন মহাপ্রভুর আবির্ভাব তিথি বলে গোস্বামী পরিবারের কেউ সে দিন আবির, রং স্পর্শ করেন না।” পূর্ণিমার ন’দিনের মাথায় হয় মহাপ্রভু মন্দিরের নিজস্ব দশম দোল। একই ভাবে গোরাচাঁদের আখড়ায় পালিত হয় দশম দোল। সোনার গৌরাঙ্গ বাড়ি বা শ্রীবাস অঙ্গনে হয় পঞ্চম দোল। বড় আখড়ার শ্যামসুন্দর মন্দিরে হয় তৃতীয় দোল।

সোনার গৌরাঙ্গ মন্দিরের প্রধান স্বরূপ দামোদর গোস্বামী জানান, নবদ্বীপের অপর নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। রাধাকৃষ্ণের দোল শেষ না হওয়া পর্যন্ত মহাপ্রভুর দোল বিধেয় নয়। সেই জন্য তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা মূল দোলের পাঁচ দিন পরে পঞ্চম দোলের প্রথা চালু করেছিলেন অন্তত আড়াই’শো বছর আগে। পঞ্চম দোলের আগের দিন হয় চাঁচর বা নেড়াপোড়া। ‘চোদ্দো মাদল’ বা মৃদঙ্গ নিয়ে নগরকীর্তনে বেড়িয়ে নিত্যানন্দের বংশধরেরা গাইতে থাকেন হরিদাস ঠাকুরের পদ, “তোহার চরণে মন লাগুরে, হে স্মরণ্যনাথ।”

মহাপ্রভু মন্দিরে এই ধারাবাহিক দোল উৎসব পালিত হয় দোলের দশম দিনে। তাই এই দোলের নাম দশম দোল। মহাপ্রভুর সেবাপুজো যাবতীয় দায়িত্ব সামলান শ্রীশ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া সেবা সমিতি। দশম দোল প্রসঙ্গে তাঁদের ব্যাখ্যা একটু অন্যরকম। সুদিন গোস্বামী জানান, বিষ্ণুপ্রিয়াদেবীর দুই প্রিয় সখি কাঞ্চনা এবং অনিতা মহাপ্রভু এবং বিষ্ণুপ্রিয়াকে নিয়ে এই দশমী তিথিতে রং খেলেছিলেন। সেই বিশেষ তিথিকে স্মরণে রেখে তাঁদের পূর্বসুরি রামকন্ঠ গোস্বামী, পাঁচুগোপাল গোস্বামী বা ফনিভূষণ গোস্বামীরা দশম দোলের প্রচলন করেন। তিনশো বছর ছুঁই ছুঁই দশম দোলের দিন মহাপ্রভুকে বিষ্ণুপ্রিয়াদেবী-সহ দোলনায় দোলানো হয়। গোস্বামী পরিবারের মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে নগর প রিক্রমায় যোগ দেন। সারা শহর ঘুরে মন্দিরে পৌঁছনোর পরে শুরু হয় হোলি কীর্তন‘‘ফাগু খেলত গোরা বিষ্ণুপ্রিয়া সঙ্গে, মারে পিচকারি দুঁহুঁ দোঁহা অঙ্গে।” শুরু হয় মহাপ্রভুর পায়ে আবির দিয়ে রং খেলা। এ দিন দোলের পরিক্রমায় শোনা যায় কিছু দুর্লভ অপ্রচলিত কীর্তনের পদ। সুদিনবাবু বলেন, “দশম দোলের যাবতীয় গান মহাপ্রভু বাড়ির নিজস্ব সম্পদ। এর কথা, সুর সবই গোস্বামীদের রচনা।” এ দিন মহাপ্রভুকে নানা রকমের সরবত দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে নানা রকম ফল। আর রাতে হয় খিচুড়ি। বছরে এই একটি দিনেই মহাপ্রভু মন্দিরে রাতে অন্নভোগ দেওয়া হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

doljatra nabadwip debasish bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE