খসে পড়েছে নাম ফলক। গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
ধুলোয় লুটোচ্ছে ইতিহাস!
বছর কুড়ি আগে উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার বহরমপুর ডিভিসনের বাস টার্মিনাসের উদ্বোধন হয়। নাম রাখা হয় ‘মীরমদন-মোহনলাল’। এখন ওই টার্মিনাসে ঢোকার মুখে স্টিলের পাতে লেখা নামে মোহনলালের কোনও অস্তিত্ব নেই। আর মীরমদনের ‘মী’-খসে পড়েছে অনেকদিন আগেই। এখন কোনওরকমে ঝুলছে ‘রমদন’।
পলাশির যুদ্ধে নবাব পক্ষের দুই সেনাপতি মীরমদন ও মোহললাল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়ে মারা যান। মুর্শিদাবাদবাসী এখনও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন মীরমদন-মোহনলালকে। ১৯৯৬ সালে তত্কালীন পরিবহণমন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী ওই বাস টার্মিনাসের উদ্বোধন করেন। প্রায় সাড়ে তিন একর জায়গা জুড়ে তৈরি টার্মিনাসটি নামকরণ করা হয় ‘মীরমদন-মোহনলাল’-এর নামে। তারপর দিনে দিনে জীর্ণ হয়েছে বাস টার্মিনাস। সংস্কার হয় না টার্মিনাসের কোনও অংশে। অযত্নের অঙ্গ হিসেবে টার্মিনাসের মুখে বড় করে লেখা মোহনলালের নাম খসে পড়েছে অনেক আগেই। মীরমদনের নামের আদ্যক্ষরের কোনও উপস্থিতি নেই টার্মিনাসের নামে। এলাকাবাসীদের অভিযোগ, একাধিক বার টার্মিনাস কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানিয়েও কোনও ফল মেলেনি।
মাস খানেক আগে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন স্মারকলিপিও দেয় উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার বহরমপুর ডিভিসন কর্তৃপক্ষের কাছে। সংগঠনের মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিজয় ভৌমিক বলেন, “পলাশির যুদ্ধে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করে মারা যান মীরমদন ও মোহনলাল। সেই কারণে বাম আমলে তাঁদের নামে ওই টার্মিনাস তৈরি হয়। কিন্তু বর্তমান কর্তৃপক্ষ সে সবের কোনও মর্যাদাই দিচ্ছেন না। ওঁদের নাম খসে পড়ছে। সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই কারও।” আইএনটিইউসি অনুমোদিত মুর্শিদাবাদ জেলা বাস-শ্রমিক ইউনিয়নের সম্পাদক সনত্ বসুও খোলাখুলি বলছেন, “আমরা এ ব্যাপারে টার্মিনাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।”
শুধু নামের একাংশ খসে পড়াই নয়, গোটা টার্মিনাস জুড়েই অব্যবস্থা ও জীর্ণতার ছাপ স্পষ্ট। শুরুতে বহরমপুর থেকে কলকাতার জেলার দূরবর্তী এলাকারও বাস মিলত এখান থেকে। পড়শি জেলা নদিয়ায় যাওয়ার জন্যও দিনে একাধিক বাস ছাড়ত এই টার্মিনাস থেকে। এমনকী পড়শি রাজ্য ঝাড়খন্ড-বিহার-অসমে যাওয়ারও বাস পাওয়া যেত এখান থেকেই। এখন প্রায় সব রুট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সারাদিনে কেবলমাত্র বহরমপুর-জিয়াগঞ্জ রুটে একটিমাত্র বাস চলে। বাসের সংখ্যা তলানিতে ঠেকার পাশাপাশি কমেছে কর্মী সংখ্যাও। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টার্মিনাসের পাশেই বিকল হওয়া বাস মেরামতির জন্য তৈরি গ্যারাজেরও বেহাল দশা। অষ্টপ্রহর বন্ধ থাকে গ্যারাজের ফটক। ফলে বিকল বাসগুলি সারানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। বিগড়ে যাওয়া একাধিক বাস খোলা আকাশের নীচে পড়ে রয়েছে। রোদ-জলে ক্ষতি হচ্ছে বাসগুলির।
বহরমপুরের বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তী বলেন, “ওই বিকল বাসগুলি দীর্ঘদিন ধরে না সারানোর ফলে সেগুলি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। টার্মিনাস কর্তৃপক্ষ সব কিছু দেখেও না দেখার ভান করছেন।” শুরুতে টার্মিনাসের উপর তলায় দূরপাল্লার যাত্রীদের কম খরচে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কিন্তু ক্যান্টিনে তালা পড়েছে বছর খানেক আগে। নেই-এর তালিকা আরও দীর্ঘ। আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের নলকূপ বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। শৌচালয় শেষ কবে পরিষ্কার হয়েছে তা মনে করতে পারছেন না কেউ। প্রথমদিকে টার্মিনাসের ভিতরে জেলার কারুশিল্পীদের বিভিন্ন রকম হাতের কাজের নমুনা রাখা ছিল। পেল্লাই সাইজের কাচের অ্যাকোরিয়ামও ভেঙেচুরে গিয়েছে। সব মিলিয়ে জেলার সর্ববৃহত্ বাস টার্মিনাস এখন কার্যত নেই রাজ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার বহরমপুর ডিভিসনের ম্যানেজার উত্তমকুমার গণ অবশ্য আশ্বাসের সুরে বলছেন, “টার্মিনাসটি সংস্কারের জন্য পরিবহণ দফতর অর্থ বরাদ্দ করেছে। দ্রুত শুরু হবে হাল ফেরানোর কাজ।” কিন্তু কবে? তা জানেন না জেলাবাসী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy