Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Durga Puja 2020

অ-সুখ মুছে জীবনের সঙ্গীত

এ ক’দিনে যেন কিছুই মনে নেই। দিন সাতেক হল হাসপাতালের বিছানায়। জ্বর, ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নবনীতা গুহ
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২০ ০৪:৫৮
Share: Save:

“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর…”

হাল্কা সুর কানে যেতেই ঘুম ভেঙে গেল অসীমার। ভুল শোনেননি তো কিছু? নাহ্, ওই তো… পাশের বিছানা থেকে মোবাইলের হাল্কা আওয়াজ। তবে কি আজ মহালয়া? তবে কি সেই সময় চলে এল?

এ ক’দিনে যেন কিছুই মনে নেই। দিন সাতেক হল হাসপাতালের বিছানায়। জ্বর, ঠান্ডা লাগা, শ্বাসকষ্ট। বাড়ির লোকেদের মুখও দেখেন না কত দিন। যে দিন আচ্ছন্ন অবস্থায় মেয়ে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে, বিছানায় শুয়ে তার চলে যাওয়া দেখছিলেন আধ বোজা চোখে। জল গড়িয়ে পড়েছিল, আর কি দেখা হবে…

হবে, আর দিন সাতেকের মধ্যে। ডাক্তার দিদি বলেছেন, আর বেশি দিন ভর্তি থাকতে হবে না। কাল সন্ধ্যায় নার্সদিদিও বলে গিয়েছেন, এখন অনেকটাই সুস্থ তিনি। এখানে সকলেই একা, বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা নেই। প্রত্যেকের মুখে অজানা আতঙ্ক। কিন্তু ডাক্তার আর নার্সদিদিরা যখন এসে বলে যান, ‘ভয় কী, আমরা আছি তো…’, মনে হয়, এ-ই তো আগমনির আলো। যাঁদের হাত ধরে টুটবেই পথের নিবিড় আঁধার সকল বিষাদ কালো…।

সকালের শিউলি কুড়োতে গিয়ে শঙ্করের আজ খুব মনে পড়ছিল সেই দিনটার কথা। কাজ হারিয়ে পড়শি রাজ্য থেকে ফিরছিল সে। বাড়িতে জানিয়েছিল। কিন্তু গ্রামে ঢোকার আগেই পথ আটকান প্রতিবেশীরা। জানানো হয়েছিল, ঢুকতে পারবেন না। যদি শরীরে থেকে থাকে করোনার বিষ! বাড়ির মানুষগুলিও কেমন নিরুপায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল দূরে। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক দিদি। বুঝিয়েছিলেন অনেক। শেষে চোদ্দো দিন গ্রামের বাইরে পরিত্যক্ত এক ঘরে কাটিয়ে এল বাড়ি ফেরার পালা। এরই মধ্যে শারীরিক পরীক্ষা হয়েছে। আশা-দিদিরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সকলকে বুঝিয়েছেন, সচেতন করেছেন। তাঁদের দেখতে দেখতে আশ্বিনের শারদপ্রাতে সেই দশপ্রহরণধারিণীদের মুখই মনে পড়ে যায় শঙ্করের।

বিপদের ধরন কী এক! গ্রামে একটা মাত্র উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ভরসা সুমতিদের। সেখানে যে বড় নার্সদিদি আসেন, তিনিও এক দিন করোনায় আক্রান্ত। ওই নার্সদিদিরাই তো বারবার এসে বুঝিয়ে যাচ্ছিলেন, ভয় পেয়ো না। খবরটা শুনে তাই চোখে জল এসেছিল ওদের। সপ্তাহদু’য়েক পরে এক শিউলি-ফোটা সকালে দিদি যখন আবার কাজে যোগ দিলেন, এক ছুটে চলে গিয়েছিল সুমতি। মাথার উপর হাত তুলে প্রণাম সেরেছিল, যেন দিদিই সেই অসুরদলনী, দুর্গতিহারিণী।

দিনপনেরো পরে আজ আবার হাসপাতালে নিজের ঘরে বসে শরণ্যা। একের পর এক রোগী দেখছেন। যে হাসপাতালের ডাক্তার তিনি, এ ক’দিন সেখানেই বিছানায় শুয়ে কেটেছে। বাড়ি যাননি মাসছয়েক। বছরখানেকের শিশুকন্যাটির সঙ্গে দেখা নেই সেই কবে থেকে। দিনপনেরো আগে যখন শুনলেন, তিনি এবং আরও দু’জন নার্স আক্রান্ত, প্রথমেই মনে হয়েছিল, কী হবে রোগীদের! আজ সুস্থ হয়ে ফিরেছেন নিজের চেম্বারে। নিজের নেগেটিভ রিপোর্ট রেখে দিয়েছেন এমন জায়গায়, যাতে তা রোগীদের চোখে পড়ে। এক বৃদ্ধা রোগী এসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘এ সবের দরকার নেই, মা। তুমিই তো ‘শান্তি দিলে ভরি দুখরজনী গেল তিমির হরি’।’’

ছ’দিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে অপর্ণাকে অনেকেই গ্রামে গ্রামে না ঘোরার পরামর্শ দিয়েছিলেন। উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্য সহায়ক পদে কাজ করা অপর্ণা বলেছিলেন, “ছাব্বিশ বছর ধরে ওই গ্রামে কাজ করছি। ওখানে যাব না?” কাজে ফিরে প্রথম দিনই দেখছিলেন শিশুদের টিকা দিতে মায়েদের লম্বা লাইন। সদ্য সুস্থ অপর্ণাই খানিক ইতস্তত করছিলেন। কিন্তু গ্রামের বাসিন্দারাই এগিয়ে এসে হাত ধরে বললেন ভয় না পেতে।

এই ভাবেই করোনা নামে মহা শক্তিধর শত্রুর মোকাবিলা করে ওঁরা ফিরে এসেছেন, অসুখ থেকে ফের সুখের আলোয়। কাছের মানুষরা তাঁদের আপন করে নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গেই শারদীয় বাতাসে সুর উঠেছে: আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও, আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধূলার ঢাকা, ধুইয়ে দাও...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Durga Puja 2020
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE