Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নোটের লাইনে রাজনীতির জল

নোট বদলের দিন গড়াল সপ্তম দিনে। অথচ ব্যাঙ্ক, এটিএম, ডাকঘরের সামনে লাইনের দৈর্ঘ্য যেন কমছে না কিছুতেই! মঙ্গলবার সেই দীর্ঘ লাইনের পাশেই দিনভর দেখা গেল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের।

নম্বরের অপেক্ষায়। ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন। (ডান দিকে) মঙ্গলবার বোলপুরে ব্যাঙ্কের লাইনে জল বিলোলেন অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

নম্বরের অপেক্ষায়। ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন। (ডান দিকে) মঙ্গলবার বোলপুরে ব্যাঙ্কের লাইনে জল বিলোলেন অনুব্রত মণ্ডল। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৩১
Share: Save:

নোট বদলের দিন গড়াল সপ্তম দিনে। অথচ ব্যাঙ্ক, এটিএম, ডাকঘরের সামনে লাইনের দৈর্ঘ্য যেন কমছে না কিছুতেই! মঙ্গলবার সেই দীর্ঘ লাইনের পাশেই দিনভর দেখা গেল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের। কেউ এগিয়ে দিয়েছেন জল-বিস্কুট, তো কেউ চা-বিস্কুট! তৃণমূলের দাবি, জেলাজুড়ে গ্রাহকদের পাশে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। দিনভর সেই কর্মসূচিই পালন করা হয়েছে। বিজেপির দাবি, কাউকে দেখে নয়। মানবিকতার খাতিরেই এমন পাশে থাকা!

দিন কয়েক ধরেই জেলা তৃণমূলের অলিন্দে কথাটা ঘোরা ফেরা করছিল। প্রধানমন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু রাজ্যবাসীর ভোগান্তিতে কিছুটা প্রলেপ দিতে জল বিস্কুট বা কোথাও চা দেওয়ার চল শুরু হয়েছে। এ দিন সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ বোলপুরের চিত্রা মোড়ের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাউন্টারে ফি দিনের মতো হাজার খানেক লোক দাঁড়িয়ে। দলীয় কর্মী-সমর্থক নিয়ে আচমকা লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। গ্রাহকদের মধ্যে একটু কিন্তু ভাব ছিল। এই বুঝি মন্ত্রীকে লাইন ছাড়তে হয়! আচমকা জলের বোতল এবং বিস্কুট এগিয়ে দিলেন সহকর্মীরা। আনুষ্ঠানিক ভাবে ওই কাউন্টার থেকে শুরু করলেন চন্দ্রনাথ। লাইনে দাঁড়ানো সকল গ্রাহকদের কাছে না পৌঁছতে পেরে, তাদের আশ্বস্ত করেন ‘‘কেষ্টদা’ আসছেন চিন্তা নেই। সকলে জল বিস্কুট পাবেন।’’

১২টা নাগাদ হাজির অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্ট।

তাঁকে দেখেই লাইনে দাঁড়ানো কেউ কেউ জায়গা ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন কেষ্টদা এদিকে আসুন। তাঁর অনুগামীরা অবশ্য জানান, কেষ্টদা জল বিস্কুট দিতে এসেছেন। ততক্ষণে নিরাপত্তা রক্ষী থেকে শুরু করে দলের কর্মী-সমর্থকেরা একে একে জলের বোতল এবং বিস্কুট বাড়িয়ে দিয়েছেন অনুব্রতকে। অনুব্রত বলেন, ‘‘আপনাদের ভোগান্তি ও অসুবিধের কথা মাথায় রেখে জল বিস্কুটের আয়োজন। জেলার সমস্ত ব্যাঙ্ক এবং মঙ্গলকোট আউসগ্রাম, কেতুগ্রাম এলাকায় তৃণমূলের উদ্যোগে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বাসিন্দাদের জল বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে।’’

এ দিনও ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস বা এটিএমের সামনে টাকা তোলার লাইনের ছবিটা একই ছিল। সিউড়ি, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, বোলপুর-সহ জেলার অন্য এলাকাগুলিতে এটিএম চালু হয়েছে। কয়েকটি এটিএমে দুপুরের মধ্যে টাকা শেষ হয়ে যায়। সাঁইথিয়ার নেতাজি পল্লির ব্রাঞ্চ পোস্ট অফিসে দশ টাকার কয়েন না নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ দিন দুপুর একটা নাগাদ পোস্ট মাস্টারের সঙ্গে তর্ক করতে দেখা যায় কয়েকজন গ্রাহকের। পোস্ট মাস্টার শ্রীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, ‘‘কয়েন নেওয়া বা না নেওয়ার কোনও নির্দেশ নেই। তাই কয়েন নেওয়া যাবে না।’’ এ দিকে ডাকঘরের দেওয়ালে একটি নোটিস ঝুলতে দেখা যায়, একটি বইয়ে ৪৯.০০০ হাজার টাকার বেশি জমা করা যাবে না।’’ এতে বিতর্ক ছড়ায় শহরে। কয়েন না নেওয়ার প্রশ্নে এবং এই নোটিস নিয়ে মুখ্য ডাকঘরের পোস্ট মাস্টার ভবানী গড়াই বলেন, ‘‘কয়েনের ব্যাপারটি আমারও ঠিক জানা নেই। আর যে নোটিসের কথা বলছেন, সেটা কাল সংশোধন করা হবে।’’

নোট বদলের হয়রানির সপ্তম দিনে রামপুরহাট মহকুমার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সামনেও গ্রাহকদের টাকা জমা দেওয়া, নোট বদল, টাকা তোলার দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে। সোমবার এটিএম পরিষেবা যথার্থ চালু না থাকার জন্য মঙ্গলবার সকাল থেকেই বিভিন্ন এটিএম কাউন্টার খোলার অপেক্ষায় ছিল জনতা। কিন্তু অনেক এটিএম কাউন্টার বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আজও বন্ধ ছিল। আবার শহরে যেগুলি চালু ছিল সেগুলিতেও দীর্ঘ লাইন লক্ষ করা যায়।

এ দিন সকালে নলহাটি থানার ভদ্রপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় একটি রাষ্টায়ত্ত ব্যঙ্কের সামনে ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে ভিড়। সকাল দশটার সময় ব্যাঙ্ক খুললে দেখা যায় প্রায় লাইনে দাঁড়ানো দুই শতাধিক জনতার একাংশ লাইন ভেঙে ব্যাঙ্কে আগে ঢোকার জন্য গেট ধরে টানা হ্যাঁচড়া করছেন। এলাকায় পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি সামাল দেয়। ব্যাঙ্ক সংলগ্ন এটিএম কাউন্টারের ঝাঁপ বন্ধ রাখা হয়। এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘‘লোহাপুর, ভদ্রপুর এলাকায় ব্যাঙ্ক আছে। এটিএম পরিষেবা আছে। অথচ দুই জায়গাতেই এটিএম পরিষেবা বুধবার থেকেই বন্ধ।’’

ভদ্রপুরের ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়ানো নগরা গ্রামের বাসিন্দা মফিজুল সেখ বলেন, ‘‘ওই ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচশো, হাজার টাকা বদল করা হচ্ছে না। এর ফলে গ্রাহকরা হয়রান হচ্ছেন।’’ হয়রানির চিত্র মিলেছে রামপুরহাট ও নলহাটিতে ব্যাঙ্কের সামনে। এ দিন সকাল থেকে তারাপীঠ, মল্লারপুর, রামপুরহাট এই সমস্ত জায়গার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সামনে তৃণমূল নেতাদের দেখা যায় জল চা নিয়ে গ্রাহকদের কাছে যেতে। দুপুরে রামপুরহাট স্টেট ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়ানো জনতাদের জল পরিবেশন করতে দেখা গেল মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

তিনি বলেন, ‘‘শহরের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনতারা হয়রান হচ্ছেন। সেই জন্য দলের পক্ষ থেকে জল, চা বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে।’’

ঘটনা হল, ভোটের সময় ‘গুড়-বাতাসা-জল’ খাইয়ে ভোট করার বিধান দিয়েছিলেন তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। জেলা বিজেপি সেই কথা স্মরণ করিয়ে কটাক্ষ করে, নির্বাচন কমিশনের নিয়ম নীতির চাপে পড়ে ভোটারদের সবাইকে ‘গুড়-বাতাসা-জল’ খাওয়ানো হয়ে ওঠেনি সে সময় তৃণমূলের। এখন ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস ও এটিএমে টাকা তুলতে আসা লোকজনকে ‘গুড়-বাতাসা-জল’ খাইয়ে সভাপতির সেই ইচ্ছা কিছুটা পূরণ করলেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। সাঁইথিয়ার ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ তা খেতে খেতেই বলে ফেললেন, ‘‘একেই বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো!’’

সাঁইথিয়া তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সাবের আলি খান, শহর সভাপতি পিনাকী দত্ত, জেলা সদস্য সাধন বন্দ্যোপাধ্যায়রা জানান, মমতাদি (বন্দ্যোপাধ্যায়) ও কেষ্টদার কথা মতো দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়ানো সাধারণ মানুষকে গুড়-বাতাসা, জল-চা, বিস্কুট দেওয়া হয়েছে। এটা মানুষ হিসাবে কর্তব্য। এতে রাজনীতি নেই।’’

এ দিন অবশ্য সাঁইথিয়ায় বিজেপির কর্মি ও সমর্থকদের দেখা যায় নোট বদলের লাইনে চা-বিস্কুট দিতে। যদিও দলের শহর সভাপতি গৌতম গোলছা বলেন, ‘‘কারও দেখে বিজেপি কিছু করে না। বিজেপি কর্মীরা যা করেন, তা মানবতার খাতিরে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anubrata Mandal Bank Line
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE