Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
পুলিশ দেখে গা ঢাকা দিল বাবারা

একই গ্রামে পাঁচ নাবালিকার বিয়ের আয়োজন

একই দিনে একই গ্রামে পাঁচ নাবালিকার বিয়ে। প্রশাসনের উদ্যোগে সেই বিয়ে রুখল বটে, কিন্তু সামনে উঠে এল অনেকগুলি প্রশ্ন। শনিবার পুরুলিয়ার বরাবাজারের একটি গ্রামে ওই পাঁচ নাবালিকার বিয় রুখে দেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। তার আগের দিন বাঁকুড়ার রানিবাঁধ এলাকার এক কিশোরীর বিয়েও রোখা হয়েছে।

আধিকারিকদের দেখতে পড়শিদের ভিড়।—নিজস্ব চিত্র

আধিকারিকদের দেখতে পড়শিদের ভিড়।—নিজস্ব চিত্র

সমীর দত্ত
বরাবাজার শেষ আপডেট: ০১ মে ২০১৬ ০১:১৩
Share: Save:

একই দিনে একই গ্রামে পাঁচ নাবালিকার বিয়ে। প্রশাসনের উদ্যোগে সেই বিয়ে রুখল বটে, কিন্তু সামনে উঠে এল অনেকগুলি প্রশ্ন। শনিবার পুরুলিয়ার বরাবাজারের একটি গ্রামে ওই পাঁচ নাবালিকার বিয় রুখে দেন পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারা। তার আগের দিন বাঁকুড়ার রানিবাঁধ এলাকার এক কিশোরীর বিয়েও রোখা হয়েছে। দু’ দিন আগে জয়পুরে রোখা হয়েছে তিন নাবালিকার বিয়ে। নাবালিকা অবস্থায় মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার এই হিড়িক চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে প্রসাশনের কর্তাদের কপালে। সাধারণ মানুষ সচেতন না হলে, শুধু আইনি তৎপরতায় কত দিন আগলে রাখা যাবে কিশোরীদের— তা নিয়ে সংশয়ে দেখা দিয়েছে খোদ কর্তাদের মধ্যেই।

পুরুলিয়া জেলা চাইল্ড লাইনের প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর দীপঙ্কর সরকার জানান, শুক্রবার তাঁরা একটি চিঠি হাতে পান। তাতে জানানো ছিল, বরাবাজারের একটি গ্রামে কন্যাশ্রী প্রকল্পে নাম রয়েছে এমন ছয় নাবালিকার বিয়ের বিয়ের তোড়জোড় চলছে। শনিবার পুলিশকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে গ্রামে যান বরাবাজারের বিডিও বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস এবং চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। হঠাৎ পুলিশের গাড়ির পিছনে সারি সারি ঢুকতে দেখে গ্রামবাসীরা জড়ো হয়ে পড়েন। তাঁদের থেকে ওই নাবালিকাদের নাম করে বাড়ির হদিশ জেনে নেন চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, চিঠিতে উল্লেখ করা ওই ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনই নাবালিকা।

বাড়িতে পুলিশ আসতে দেখে ওই নাবালিকাদের বাবারা সরে পড়েন। সব বাড়িতেই চাইল্ড লাইনের আধিকারিকদের মুখোমুখি হন মেয়েদের মায়েরা। বয়সের প্রমাণপত্র দেখে জানা যায় ছ’ জনের মধ্যে পাঁচ জনই পনেরো বছরের কম বয়সী। প্রশাসনের প্রতিনিধিরা ওই পাঁচ নাবালিকার মায়েদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের বোঝানো হয় কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে শারীরীক নানা সমস্যা হতে পারে। বোঝানো হয় নাবালিকা বিয়ের আইনি জটিলতাও।

আইনকানুনের দিকটা মায়েরা আগে থেকে জানতেন না বলে দাবি করেন আধিকারিকদের কাছে। কিন্তু, কম বয়সে বিয়ে হলে বাকি জীবনটা যে স্বাস্থ্যের সমস্যা নিয়ে কাটাতে হয়, সেই বিষয়টি? এক নাবালিকার মা বলেই ফেলেন, কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁরও। তিনি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন, অল্প বয়সে বিয়ের কুফল। কিন্তু সমাজিকতা বড় দায়। বলেন, ‘‘ভাল পাত্র পেয়েছিলাম। আমাদের সমাজে রেওয়াজটাই তো এ রকম। বুকে পাথর চাপা দিয়ে তাই মেয়েটাকে বিয়ে দিতে গিয়েছিলাম। সমস্ত বুঝেও তো মেয়েদের কিছু করার থাকে না।’’

সমাজের দায় তা ততক্ষণে দানা বাঁধতে শুরু করে দিয়েছে ওই বাড়িগুলির সামনে। পড়শিরা ভিড় করেছেন সেখানে। সেই ভিড়ের মধ্যে বেশি দেখা গেল গ্রামের পুরুষদেরই। তাঁদের মধ্যে স্পষ্ট দু’টি বিভাজন চোখে পড়ল। এক দল চাইল্ড লাইনের কর্মীদের সমর্থন করলেন। কিন্তু বাকিদের মত ভিন্ন। তাঁরাই আবার দলে ভারি। সামাজিক প্রথা, ভাল পাত্রের অভাব ইত্যাদি নানা অজুহাত উঠে আসতে শুরু করে তাঁদের আলোচনায়। কে বা কারা চাইল্ড লাইনে চিঠি দিয়ে বিয়ের খবর ফাঁস করে দিল শুরু হয় সেই খোঁজ।

আধিকারিকদের মুখোমুখি না হলেও গ্রামের পুরুষদের একটি বড় অংশ যে আড়ালে নাবালিকা বিয়ের পক্ষে জোরালো সওয়াল করে চলেছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি চাইল্ড লাইনের কর্মীদের। বাইরে বেরিয়ে ভিড়ের মুখোমুখি হন তাঁরা। বোঝানোর চেষ্টা করেন, মেয়েদের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তার অজুহাত কেন ধোঁপে টেঁকে না। কন্যাশ্রীর টাকায় অনেক মেয়েই যে স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, বাপ-দাদাদের দু’ বেলা ভাতের যোগান দিয়েছে— তার নজির তুলে ধরেন তাঁরা। ভিড়ের জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, মেয়েদের স্বাধীন ভাবে বাঁচা এবং স্বাধীন ভাবনা চিন্তা করার জন্য স্কুল কলেজে পড়াশোনা করা কতটা জরুরি। চাইল্ড লাইনের সদস্য ঝর্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই গ্রামের মানুষজনের মধ্যে এখনও সচেতনতার অভাব রয়ে গিয়েছে। মেয়ে মানে পরিবারের বোঝা নয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দিলে, ছেলেদের মতো তারাও পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে।’’

তবে প্রচার করে বোঝানোয় তো খামতি ছিল না প্রশাসনের। তাহলেও কেন কাজ হচ্ছে না। বিডিও (বরাবাজার) বিনয়কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘খবরের কাগজে প্রায় দিনই নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করার কথা উঠে আসে। এলাকায় প্রচার করা হয়। এই সংক্রান্ত আইনকানুন গ্রামের মানুষের অজানা থাকার কথা নয়।’’ প্রশাসনের আধিকারিকদের একাংশের মতে, লোকাচার দোহাই মাত্র। মেয়েরা যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, স্বাবলম্বী হতে পারে তা জেনেও অভিভাবকেরা নাবালিকা অবস্থায় তাদের বিয়ে দিয়ে দিতে চান। এর মূলে রয়েছে বাকি সমাজের চাপ। যে চাপের ছবিটা এ দিন স্পষ্ট হয়ে গেল ওই নাবালিকাদের বাড়ির বাইরে ভিড় করা প্রতিবেশীদের আচরণে। বিডিও জানিয়েছেন, আপাতত এলাকায় শিবির করে প্রচারে জোর দিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন তাঁরা।

শনিবারই বাঁকুড়া জেলা চাইল্ড লাইনের কর্মীরা রানিবাঁধ থানা এলাকায় এক কিশোরীর বিয়ে রুখে দেন। বাঁকুড়া জেলা চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সজল শীল জানান, শনিবার বছর ষোলোর ওই কিশোরীর সঙ্গে সারেঙ্গা থানা এলাকার এক যুবকের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। শুক্রবার বিকেলে সেই খবর তাঁদের কাছে পৌছয়। পরে গ্রামে গিয়ে কিশোরীর অভিভাবকদের বুঝিয়ে বিয়ে রোখা হয়। আঠারো বছর বয়েস হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেবেন না বলে মুচলেকা দেন অভিভাবকেরা।

পুরুলিয়ার জয়পুর থানা এলাকায় তিন নাবালিকার বিয়ের খবর বুধবার সন্ধ্যায় চাইল্ড লাইনের কাছে আসে। তিন নাবালিকার স্কুলে যোগাযোগ করে তাদের বয়স সম্বন্ধে নিশ্চিত হন চাইল্ড লাইনের কর্মীরা। জেলা চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর দীপঙ্কর সরকার জানান, অভিভাবকদের বুঝিয়ে সেই বিয়ে আটকানো হয়। ওই তিন জন নাবালিকার মধ্যে দু’জনই চাইল্ড লাইনের কর্মীদের জানায়, তারা বিয়ে করতে চায়নি। এই বিয়ে যে আইনে আটাকায় তা অভিভাবকদের বুঝিয়ে বলেছিল। কিন্তু ‘ভাল পাত্র’ পাওয়ায় তাদের সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি।

প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘সতীদাহের মত কু-প্রথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লোকাচারের দোহাই দিয়ে মেয়েদের অবদমিত করে রাখা যাবে না। বাল্য বিবাহও বন্ধ হবে।’’ তবে তাঁর মতে, ‘‘মেয়েরা বোঝে। মায়েরাও বোঝেন। কিন্তু সমাজের বাকিরা যত দিন না মানবিকতার সঙ্গে বিষয়টি ভাববেন, প্রশাসনকে নজরজদারি চালিয়ে যেতেই হবে।’’

সহ প্রতিবেদন: প্রশান্ত পাল ও দেবব্রত দাস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE