Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দাবদাহের বলি শৌখিন মাছও

• চিত্র ১: বহু বছর ধরে অসুস্থ সিউড়ির ডাঙালপাড়ার সুপ্রিয়াদেবী। পড়ে গিয়ে হিপ-জয়েন্টের হাড় ভাঙায় চলাফেরার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। স্ত্রী-র মন ভাল রাখতে বছর চারেক আগে অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ পুষতে শুরু করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী সুবিমল চক্রবর্তী।

এই গরমে ধুঁকছে অ্যাকোরিয়ামে থাকা রঙিন মাছও। শুক্রবার সিউড়িতে সোলা নিজস্ব চিত্র।

এই গরমে ধুঁকছে অ্যাকোরিয়ামে থাকা রঙিন মাছও। শুক্রবার সিউড়িতে সোলা নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১৯
Share: Save:

• চিত্র ১: বহু বছর ধরে অসুস্থ সিউড়ির ডাঙালপাড়ার সুপ্রিয়াদেবী। পড়ে গিয়ে হিপ-জয়েন্টের হাড় ভাঙায় চলাফেরার শক্তি হারিয়েছেন তিনি। স্ত্রী-র মন ভাল রাখতে বছর চারেক আগে অ্যাকোরিয়ামে রঙিন মাছ পুষতে শুরু করেছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী সুবিমল চক্রবর্তী। সেই শুরু। বর্তমানে ওঁদের বাড়িতে ছ’টি অ্যাকোরিয়াম। সারাক্ষণ নানা রঙের উপস্থিতি। ওই বৃদ্ধ দম্পতির এখন অধিকাংশ সময় কাটে মাছের খেলা দেখেই।


• চিত্র ২: ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবে দু’বছর আগে অ্যাকোরিয়াম এনে রঙিন মাছ পুষেছিলেন সিউড়ির সমন্বয়পল্লির গৃহবধূ দোলনচাঁপা ঘোষ। এখন পোষ মানানো রঙের খেলা কেমন যেন নেশা ধরিয়ে দিয়েছে দোলনচাঁপাকে। টিভি ছেড়ে অবসর কাটে অ্যাকোরিয়ামের দিকে তাকিয়ে! মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন নতুন মাছের খোঁজে ঢুঁ মারেন রঙিন মাছের দোকানে। এতে খুশি ছয়ের মেয়ে দেবাদৃতাও।


• চিত্র ৩: সকালে টোটো নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় অ্যাকোরিয়ামটার দিকে না তাকালে দিনটা ভাল কাটে না সুখেন্দুর। ছোট্টো অ্যাকোরিয়ামটার মধ্যে থাকা প্রিয় মাছগুলোই যাত্রা শুভ করে বলে ওর বিশ্বাস। মাসের পর মাস এখান রুটিন সিউড়ির কড়িধ্যা কালীপুরের বাসিন্দা পেশায় টোটো চালক সুখেন্দু ধীবরের। অনেকে এটাকে সুখেন্দুর সংস্কার বলে টিপ্পনি কাটলেও তাতে বয়েই যায়!

গত কয়েক সপ্তাহ মন ভাল নেই সুবিমলবাবু, দোলনচাঁপা, সুখেন্দুদের।

কেন?

তিন জনের উত্তরটাও এক সুরে মিলে গেল— ‘‘আর কেন! গরমের চোটে মাছগুলো যে মরে যাচ্ছে!’’ মাছ মরে গেলে যে আত্মীয়-বিয়োগের ব্যাথা। মন খারাপ তো হবেই।

সিউড়ি শহর বা তার আশেপাশে যে বা যাঁরা বাড়িতে রঙিন মাছ রাখেন, সেটা ঘর সাজাতেই হোক বা শখ করে প্রত্যেকেই বলছেন, ‘‘মাছ যে মরে যাচ্ছে! কি করব?’’ একই অবস্থা রঙিন মাছের কারবারীদেরও। সত্যতা মানছে জেলা মৎস্য দফতরও। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, জলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শুধু পুকুরের মাছ নয়, মরে যাচ্ছে অ্যাকোরিয়ামের মাছও।

বীরভূম জেলা মৎস্য দফতরের নিজস্ব ভবন বা ‘মীন ভাবন’-এর নীচে তিনটি রঙিন মাছের স্টল রয়েছে। তাতে কী নেই? — গাপ্পি, মলি, বিভিন্ন প্রজাতির গোল্ড ফিস, অ্যারোয়ানা, রেইনবো, অস্কার, ফাইটার, টাইগার, এ্যাঞ্জেল সিলভার সার্ক আরও কত প্রজাতির মাছ। অনেকের মত, ২০১১ সালে গড়ে ওঠা ওই স্টলগুলোর জন্যই শহরের বাড়িতে বাড়িতে রঙিন মাছ রাখাটা ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে।

একটি স্টল চালান স্মৃতি কাহার। স্মৃতিদেবী জানালেন, এই গরমে মাছ মরে যাওয়ার জন্য কারবারে ভাটা পড়েছে। ঘরের মধ্যেই জলের তাপমাত্রা পৌঁছে যাচ্ছে ৩৮-৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অ্যাকোরিয়ামের মাছের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রি। ‘‘অতিরিক্ত গরমে প্রতি সপ্তাহে বেশ কয়েক হাজার টাকার মাছ মরছে’’, বলছেন স্মৃতি। মাছ মরে যাওয়ায় যাঁরা রঙিন মাছ সরবরাহ করেন তাঁদের অনেকেই এই কাজ আপাতত বন্ধ রেখেছেন।

একই অভিজ্ঞতা সিউড়ির আরও এক রঙিন মাছের কারবারি অন্তু মোদকের। প্রায় দু’দশক ধরে অন্তু কলকাতা থেকে ছোট রঙিন মাছ এনে সেগুলিকে বাড়ির চৌবাচ্চায় বড় করে রঙিন মাছের কারবারিদের পাইকারি দরে বিক্রি করেন। মাসে আয় প্রায় আঠারো হাজার টাকা। গত এক মাস রোজগার হয়নি বললেই চলে, আক্ষেপ অন্তুর। যোগ করছেন, ‘‘চৌবাচ্চার জল আগুনের মতো গরম হয়ে সব মাছ মেরে গিয়েছে। অনেক টাকা ক্ষতি হয়েছে।’’

কেন এমনটা হচ্ছে?

বীরভূমের সহ-মৎস্য অধিকর্তা সৌরেন্দ্রনাথ জানা বলছেন, ‘‘পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়া-কমার সঙ্গে সঙ্গে মাছেরা দেহের তাপ কমিয়ে-বাড়িয়ে ভারসাম্য তৈরি করে। কিন্তু তাপ অত্যধিক বেড়ে গেলে সমস্যা হয়। তাতে মৃত্যুও হতে পারে।’’ সেক্ষেত্রে কী করতে হবে তা-ও জানাচ্ছেন তিনি। সৌরেন্দ্রনাথবাবুর দাওয়াই, সবার আগে জলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। পুকুরের মাছেদের ক্ষেত্রে জল পাল্টানোর উপায় না থাকালেও অ্যাকোরিয়ামের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব। জল আংশিক বদলে দিলে মাছের মৃত্যু আটকানো সম্ভব।

নিজেরা গরমে ভেপসে গেলেও সেই কাজটাই যত্ন নিয়ে করছেন দোলনচাঁপাদেবী, সুবিমলবাবুরা। নইলে যে নিশ্চিত আত্মীয়-বিয়োগ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

heat wave fancy fish
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE