ভোট শেষ। জেলার চার পুরসভা শাসকদলের দখলে। অপেক্ষা এখন, বোর্ড গঠনের। কিন্তু কে বসবেন কুর্সিতে, কবে হবে শপথ গ্রহণ? জেলার চার পুরসভাতেই ঘুরে ফিরে উঠছে্ এসব প্রশ্নই। প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিঠি আসতে দেরি থাকলেও পুরপ্রধান কে হবেন, সেই দৌড়ে একমাত্র সাঁইথিয়া ছাড়া সিউড়ি, বোলপুর বা রামপুরহাটে নাম নিয়ে চলছে জোর জল্পনা।
নির্বাচনের আগে সাঁইথিয়ার ক্ষেত্রেই পুরপ্রধান পদে বিপ্লব দত্তের নাম ঘোষিত। ঘটনা হল, বিপ্লববাবুই পুরপ্রধান ছিলেন। তাহলে কী বাকি তিনটি পুরসভার ক্ষেত্রেও বিদায়ী পুরপ্রধানরাই ফের ক্ষমতায় বহাল হবেন, নাকি অন্য কোনও নাম? এই সমীকরণ মেনে বলতে হয়, বিপ্লববাবু জয়ী হয়েছেন যেমন, জয়ী হয়েছেন সিউড়ি, বোলপুর ও রামপুরহাটের সব বিদায়ী পুর প্রধানরাই। তবে কি এই সহজ সমীকরণে তাঁদেরকেই ফের বহাল করা হবে?
তৃণমূলের অন্দরের খবর, এত সহজ নয় পুরপ্রধান নির্বাচনের সমীকরণ। সব পুরসভার অঙ্ক সমান নয়। সাঁইথিয়ার ক্ষেত্রে যা হয়েছে বাকি পুরসভাগুলিতেও তাই হবে এমন জোর দিয়ে বলতে পারছেন না দলের নেতা-কর্মীরাই। বরং তিনটি পুরসভাতেই পুর প্রধান পদে দাবিদার হিসাবে একাধিক নাম উঠে আসছে।
সিউড়ি পুরসভার উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়, যিনি এই নিয়ে চার বারের কাউন্সিলর হলেন। দু’ দু’বার সিউড়ির পুরপ্রধান পদে বসেছেন। বিদায়ী পুরপ্রধানও তিনিই ছিলেন। গতবার নির্বাচনে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জিতে পরে তৃণমূলে যোগ দিয়ে পুরপ্রধানের পদে বসেছিলেন উজ্জ্বলবাবু। কিন্তু গত পুরবোর্ডের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন স্বয়ং দলেরই বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ। পুরভোটে বিরোধীরাও সরব ছিল সেই ইস্যুতে। জল নিয়ে ক্ষোভ ছিল এলাকাবাসীর। যার দায় পুরপ্রধান হিসাবে উজ্জ্বলবাবুর উপরই বর্তায়। এদিকে সংরক্ষণের কোপে পড়ে অচেনা ওয়ার্ড থেকেও লড়তে হয়েছে উজ্জ্বলবাবুকে। কিন্তু এত প্রতিকুলতা সত্বেও আটশো-রও বেশি ভোটে জয়ী হয়ে দলের কাছে যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তিনি। তাই পুরপ্রধান হওয়ার দৌড়ে তিনিই অন্যতম দাবিদার। এ দিকে দলেরই একটি সূত্র বলছে, অভিযোগ রয়েছে ওঁর বিরুদ্ধে তাই জেলাসভাপতি অন্য কাউকে পুরপ্রধান পদে ভাবতে পারেন।
সেক্ষেত্রে যে নামটি জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে আসছে তিনি হলেন প্রণব কর ওরফে অঞ্জন। কেন না, এবার সিউড়ির পুরভোটে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির দীপক দাস ওরফে বাবনকে হারিয়েছেন তিনি। অভিজ্ঞতার নিরিখেও পিছিয়ে নেই অঞ্জনবাবু। এবার নিয়ে চতুর্থবার কাউন্সিলর হলেন। স্বল্প সময়ের জন্য উপ পুরপ্রধানও হয়েছিলেন। তবে এর আগে বাকি তিনবার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন তিনি। ২০১০ সালে দলের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় এবং দলের টিকিট না পাওয়ায় রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এক কংগ্রেস কাউন্সিলরকে জিতিয়ে এনেছিলেন তিনিই। অঞ্জনবাবুর বিরুদ্ধে সেবার ওই ওয়ার্ডে যৌথ প্রচার করেছিলেন সাংসদ শতাব্দী রায় ও তাপস পাল। যদিও যেই বিরোধ এখন অতীত। বরং রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের সঙ্গে অঞ্জনবাবুর সম্পর্ক খুবই ভাল। নির্বাচনের আগে অঞ্জনবাবুকে দলের সম্পদ বলেছেন জেলাপরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায় চৌধুরী। তাই পুরপ্রধান হওয়ার দৌড়ে তিনিই অন্যতম বাজি সন্দেহ নেই।
সিউড়ির হাওয়ায় উড়ছে আরও একটি নাম। তপন শুকুল। সিউড়ি ১৭ নম্বর ওয়ার্ড তৃণমূলের টিকিটে জেতা তপনবাবুকে অবশ্য শহরের অনেক নেতাকর্মীই চাননি। কিন্তু দল সূত্রের খবর সাংসদ শতাব্দী রায়ের পছন্দের প্রার্থী হওয়ায় জেলা সভাপতি অনুব্রত তাঁকে টিকিট দেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে এই নিয়ে ৪ বার জয়ী হলেন তপনবাবু। যদিও এর আগে তিনি কংগ্রেসের টিকিটে জিতে ছিলেন। সিউড়ি পুরসভার পুরপ্রধানও ছিলেন তিনি। ঘটনা হল, পুর প্রধানের হওয়ার দৌড়ে যিনিও এগিয়ে থাকুন, জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের নির্দেশ শিরধার্য। শেষ কথা শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন তিনজনেই।
বোলপুর অনুব্রতর খাসতালুক। ফলাফল বের হওয়ার পর শাসক দলের হাওয়া যা বলছে, তাতে পুরপ্রধান পদে পাল্লা ঝুঁকে রয়েছে পুরসভার পাঁচ বারের কাউন্সিলর তথা বিদায়ী পুরপ্রধান সুশান্ত ভকতের দিকেই। তার কারণ, প্রথমত তিনি মিষ্টভাষী, শাসক দলের প্রতিনিধি হয়েও বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল। বোলপুর শহরের উন্নয়ন ও পুর পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে তাঁর। দলের জেলা সভাপতি তথা বীরভূমে তৃণমূলের কাণ্ডারী অনুব্রত মণ্ডলের সাহায্য নিয়ে পুর উন্নয়ন তহবিলে আর্থিক যোগান স্বাভাবিক করা থেকে শুরু করে একাধিক প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি সফল পুরপ্রধান।
রাজ্যের মৎস্য মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের সঙ্গে সুশান্তবাবুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যার জেরে বিধান সভার ভোটে জিতে এলাকার বিধায়ক তথা মন্ত্রী হওয়ার পর, বোলপুর পুরসভার উন্নয়নের জন্য সুশান্তবাবুর হাতেই পুর প্রধানের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন চন্দ্রনাথবাবু। তাই পুরপ্রধান পদে তাঁকেই অন্যান্যদের তুলনায় যোগ্য প্রার্থী তালিকার শীর্ষে রাখছে দল। কিন্তু শীর্ষে থাকলেই অন্যরা দৌড়ে নেই এমনটা ভাবার কারণ নেই। দলেরই একটি সূত্রের খবর, পুরপ্রধানের পদে আরও এক জনের নাম ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে। তিনি পনেরো নম্বর ওয়ার্ডের জয়ী কাউন্সিলর শিবনাথ রায়। দলের ভিতরের খবর, জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ওয়ার্ডের বাসিন্দা শিবনাথবাবু, তাঁর কাছের লোকও।
কী বলছে রামপুরহাট?
পুরভোট পরবর্তী ফলের হাওয়ায় দুটি নাম ঘোরাফেরা করছে এই শহরের পুরপ্রধানের দাবিদার পদে। প্রথমজন চার বারের কাউন্সিলর (যদিও তিনবারই নির্দল থেকে জয়ী হয়েছেন) তথা বিদায়ী পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ঘনিষ্ট অশ্বিনীবাবু গত পুরবোর্ডের প্রথম থেকেই পুরপ্রধান ছিলেন না। বোর্ড গঠনের দেড় বছর পর রামপুরহাট পুরসভার তৃণমূলের পুরপ্রধান নির্মল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অনাস্থা আসার পর তিনি পুরপ্রধান হন। ঘটনা হল, নির্দল টিকিটে জিতে আসা অশ্বিনীবাবুর ভূমিকা অনেকখানি ছিল বোর্ডের রদলবদলে। অনাস্থার পর তিনি তৃণমূলে যোগ দেন। এবং পুরপ্রধান হিসাবে যা কাজ করেছেন তাতে সন্তুষ্ট পুরও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও। তাই দৌড়ে এগিয়ে তিনিই।
কিন্তু রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক তথা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবার বিশেষ পছন্দের লোক নন অশ্বিনীবাবু। তৃণমূলের অন্দরের খবর পুরপ্রধান পদে আশিসবাবু পছন্দের তালিকায় সবচেয়ে উপরে রয়েছে প্রথমবারের জয়ী তৃণমূল কাউন্সিলর সুকান্ত সরকারের নাম। যাঁকে প্রথম থেকে দলের টিকিট দেওয়া নিয়ে অনুব্রতর আপত্তি ছিল। তাই অশ্বিনী না সুকান্ত এই নিয়ে চাপা জল্পনা চলছেই রামপুরহাটে। যদিও এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে রাজি হননি কেউ। অশ্বিনীবাবু এবং সুকান্তবাবু, উভয়েরই দাবি দল যা ভাল মনে করবে, যা সিদ্ধান্ত নেবে, তাই মেনে নেবেন তাঁরা।
কী বলছেন বীরভূম জেলার তৃণমূলের শেষকথা?
অনুব্রতর সংক্ষিপ্ত উত্তর, ‘‘কী শোনা যাছে, কে কি বলছে, আমি বলতে পারবো না। পুরপ্রধান কে হবে, কলকাতা ঠিক করবে, দিদি ঠিক করবেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy