এ ভাবেই পরীক্ষার পথে সন্তু আনসারি। —নিজস্ব চিত্র।
কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। স্কুলের গেটের সামনে বেশ ভিড়। ইংরেজি বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ঝালিয়ে নিচ্ছিল কেউ কেউ।
হঠাৎ-ই ঘণ্টা পড়ল পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢোকার। হুড়োহুড়ি ভিড় গিয়ে হামলে পড়ল গেটের উপর। সবাই একসঙ্গে ঢুকতে চায় ভিতরে। ভিড়ের শব্দ সরিয়ে ঠিক তখনই ভেসে এল একজনের গলা, ‘আমাকে, আমাকে ঢুকতে দাও!’
পিছন থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখেই পরীক্ষার্থীদের অনেকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিল। একহাতে লেখার বোর্ড, অন্য হাতে অ্যাডমিট কার্ড। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকল ছেলেটি। সন্তু আনসারি।
ডান পায়ের মালাইচাকি নেই সন্তুর। বাঁ পা আবার মুড়তে পারে না। হাতের তালু একটু বাঁকা। সেই কারণে জিনিসপত্রও ঠিকমতো সে ধরে রাখতে পারে না। দু’ পা অপুষ্ট, সরু। দু’ পা এবং এক হাতে মাটিতে ঘষে বোরো থানার দিঘি হাইস্কুলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে এসেছে সন্তু।
মেডিক্যাল পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সে ৯০ শতাংশ প্রতিবন্ধী। তবু সন্তু থেমে থাকেনি। পড়াশুনার অদম্য ইচ্ছেয় ভর করেই সে এগিয়ে চলেছে। তাঁর বাবা কাবিল আনসারি বলেন, “ছেলে জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধী। আমার তিন ছেলে। ওই বড়। প্রথম সন্তানের এ রকম অঙ্গবিকৃতি দেখে প্রথমে আমরা খুব ভেঙে পড়েছিলাম। কয়েকজন অস্থি বিশেষজ্ঞের কাছে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি।”
বোরো থানার বারি হাইস্কুলের ছাত্র সন্তুর বাড়ি ওই থানারই পাটাপাহাড়ি গ্রামে। কাবিল আনসারি নিজে হাইস্কুলের গণ্ডী পেরোননি, কিন্তু ছেলের উৎসাহ দেখে পড়ানোয় খামতি রাখেননি। কাবিল এলাকার হাটে ছোটখাটো একটি ব্যবসা করেন। কিন্তু প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, কি করে পড়াশুনোয় এতদূর এগোল সন্তু? পুরনো কথা বলছিলেন কাবিল। বলতে বলতেই দু’ চোখে জল। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ছেলেকে কোলে করে তিনি দিয়ে এসেছেন। আবার ছুটি হলে নিয়েও এসেছেন। কিন্তু ছেলে বড় হওয়ার পরে সমস্যা বাধে। কাবিল বলেন, “আগে তবু গ্রামের স্কুলে যাতায়াত করে পড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। চতুর্থ শ্রেণিতে পাশ করার পর ওই ছেলের আর লেখাপড়া হবে না বলে পড়শিরা ধরে নিয়েছিলেন। গ্রামে হাইস্কুল নেই। সব থেকে কাছের হাইস্কুল বারিতে, কিন্তু তাও পাটাপাহাড়ি থেকে অন্তত পাঁচ কিলোমিটার দূরে। সন্তুকে কিন্তু থেমে যেতে দিইনি।”
ছেলেকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতেন কাবিল। একই ভাবে বাড়ি নিয়ে আসতেন। বছর দুয়েক হল একটি মোটরবাইক কিনেছেন। তাতে কিছুটা সুবিধা হয়েছে। সন্তুর সহপাঠী ধনঞ্জয় সিং সর্দার, সাদ্দাম আনসারি বলেন, “ওর বাবার অসুবিধা হলে আমরাই ওকে সাইকেলে চাপিয়ে স্কুলে নিয়ে যাওয়াআসা করেছি। সন্তু আমাদের খুব ভাল বন্ধু।”
বাড়ি থেকে পরীক্ষাকেন্দ্র প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে। বাবার মোটরবাইকেই সন্তু সেখানে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা দিঘি হাইস্কুলের শিক্ষক সীতেন মান্ডি বলেন, “সোমবার সন্তু যখন পরীক্ষাকেন্দ্রে এল তখনই আমরা ওকে সবরকম সুবিধা দেওয়ার কথা জানিয়েছি। দেখলাম সে বেঞ্চে বসতে পারবে না। ওর বাবার সাথে কথা বলে একটি আলাদা ক্লাসঘরে মেঝেতে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ওর পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে অসুবিধা না হয় এ জন্য স্কুলের একজন অশিক্ষক কর্মীকে দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
ছেলের পিছনে এত সময় দিলে ব্যবসার ক্ষতি হয় না? কাবিলের উত্তর, “আমি তেমন লেখাপড়া শিখিনি। এত শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ওর লেখাপড়ার জেদ দেখে আর না করতে পারিনি।”
লেখাপড়ার জন্য এই অদম্য উৎসাহ দেখেই স্কুলের শিক্ষকরাও সন্তুর ইচ্ছের উড়ানে জড়িয়ে নিয়েছেন নিজেদের। বারি হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক সাধনচন্দ্র মাহাতো বলেন, “ওকে স্কুলে কামাই হতে দেখিনি। লেখার গতি একটু ধীর। এজন্য একটু বেশি সময় নেয়। এজন্য আমরা ওকে একটু বাড়তি সময় দিই।” সন্তু এতদিনে জেনে গিয়েছে, তার লড়াই থেমে থাকার নয়। অন্যদের থেকে শিক্ষার দৌড়ে পিছিয়ে থাকতে তাই সে নারাজ।
সন্তু কোথায় পেল, এত মনের জোর?
ডান পা দিয়ে খাতাটাকে চেপে দু’হাতের চেটোর মধ্যে পেনটা শক্তভাবে ধরে লিখতে লিখতে সন্তুর উত্তর, “পড়তে ভাল লাগে, কিন্তু একটানা বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। আসলে বইয়ের জগতে এত বিস্ময় রয়েছে আগে জানা ছিল না। আমাদের পরিবারে এর আগে তো কেউ হাইস্কুল অবধি পৌছায়নি। জানি, এগোতে হবে আমাকে অনেক দূর!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy