Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

সিরিয়ার পর ইরাক: রাজনীতিই একমাত্র পথ

প্রয়োজন ছিল শাসনব্যবস্থায় সর্বদলীয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। সেনাবাহিনীকে একদলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে সব গোষ্ঠীকে শামিল করা। এক কথায়, অসাধ্য সাধন করা। সেমন্তী ঘোষ।ইরাকের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ কুয়েতের এক জনপ্রিয় কট্টর ইসলামি প্রচারক হাজাজ-আল আজমি বলেছেন এই বিপ্লব শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের বিদ্রোহ: ইরাকে সিরিয়ায় সর্বত্র, আমেরিকা থেকে শুরু করে দেশীয় স্বৈরাচারী শাসক সকলের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান।

‘শান্তি ফৌজ’। প্রেসিডেন্ট নুরি আল-মালিকির সমর্থনে। বাগদাদ, ২১ জুন। ছবি: এপি।

‘শান্তি ফৌজ’। প্রেসিডেন্ট নুরি আল-মালিকির সমর্থনে। বাগদাদ, ২১ জুন। ছবি: এপি।

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

ইরাকের ঘটনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ কুয়েতের এক জনপ্রিয় কট্টর ইসলামি প্রচারক হাজাজ-আল আজমি বলেছেন এই বিপ্লব শোষকের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের বিদ্রোহ: ইরাকে সিরিয়ায় সর্বত্র, আমেরিকা থেকে শুরু করে দেশীয় স্বৈরাচারী শাসক সকলের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান। আজকালকার দস্তুর অনুযায়ী আজমি চট করে ‘টুইট’ করে দিয়েছেন কথাটা, তাঁর ‘ওয়ান-লাইনার’ পাঁচ লক্ষ ভক্তের কাছে পৌঁছে দশ লক্ষ কান হয়ে বহু লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ ও প্ররোচিত করছে। সৌদি আরবের নানাবিধ নেট-প্রচারেও এই একই কথা বার বার, লাগাতার। শোষক-শোষিত সরলীকরণের পিছনে উহ্য থাকছে যে, ইরান ও সিরিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্রে শিয়া আধিপত্য আটকানোর এই যে সুন্নি অভিযান, তার প্রাথমিক লক্ষ্য, ইরাকের ক্রমবর্ধমান শিয়া প্রভাব চূর্ণ করা, প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকিকে গদিচ্যুত করা ও টাইগ্রিস নদী-অববাহিকা থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত যে অঞ্চলকে প্রাচীন ইতিহাসে ‘লেভান্ত্’ বলে বোঝানো হত, সেখানে সুন্নি ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। বস্তুত, যে জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসআইএস এই অভিযান চালাচ্ছে, তার পুরো নামটা ঠিক কী, তাই নিয়ে যখন নানা রকম মতভেদ, একটি মত অনুযায়ী নামটির প্রকৃত অর্থ, ‘ইরাক ও ‘লেভান্ত্‌’-এ ইসলামের প্রতিষ্ঠা বাহিনী’।

এই সংগ্রাম যে ঠিক শোষক-শোষিতের নয়, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কি এই সংগ্রাম সরাসরি শিয়া বনাম সুন্নির? সেটাও বড্ড সরল ঠেকছে না? মুশকিল হল, প্রবলপরাক্রান্ত আইএসআইএস ইরাকের বহু অংশ দখলে আনার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়াতেও প্রসারিত হচ্ছে, স্বৈরাচারী সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রবল দমনপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী জনসমাজকে নতুন করে ভরসা দিচ্ছে। আর তার সুযোগে এই সরল বাণীর জোরদার প্রচার চলছে। কখনও কখনও সরলতা তার মনোহারিণী চটক দিয়ে জটিল পরিস্থিতির উপর মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেয়, যাতে মনে হয় ঘটনাটা যেন এমনই এতই সরল, স্পষ্টাস্পষ্টি দুই সমাজের যুদ্ধ।

বিষয়টা অত সরল বা স্পষ্ট নয়। ঠিকই, সিরিয়া ও ইরাক, দুই দেশেই এই মুহূর্তে প্রধান শাসক শিয়া গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু সিরিয়ার শিয়া স্বৈরাচারীটি শিয়া-পরিচিতির থেকে স্বৈরাচারী-পরিচিতিতেই বেশি অপ্রিয়, সুতরাং তাঁর বিরুদ্ধে সংগঠিত যে বিক্ষুব্ধ জনসমাজ, তাকে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ছকে ভাগ করা মুশকিল। অন্য দিকে, ইরাকের শাসক আল-মালিকি গত বছর কয়েক শিয়া পরিচয়েই শাসন করে এসেছেন, তাই ইরাকের বিক্ষোভ-অভিযানে শিয়া-সুন্নি বিভেদ প্রথম থেকেই স্পষ্ট। আল-মালিকি যে গোষ্ঠী-শাসন চালিয়েছেন, তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক থেকেছে ইরান, প্রয়োজনে পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই পক্ষই কিন্তু খোলা গলায় আল-মালিকির শিয়া-বাড়াবাড়ির কথা বলে; প্রথম পক্ষ গর্বিত উচ্চারণে, দ্বিতীয় পক্ষ ঈষত্‌ বিরক্তি ও ভর্ত্‌সনা সহযোগে। মার্কিন বাহিনী ইরাক থেকে সরে যাওয়ার পর ক্ষমতার রাশ হাতে পেয়েই আল-মালিকি সেনাবাহিনী সহ প্রতিটি রাষ্ট্রীয় বিভাগে প্রত্যক্ষ ভাবে নিজের ব্যক্তিগত প্রতাপ এবং পরোক্ষ ভাবে শিয়া প্রাধান্য স্থাপন করে এসেছেন, নিশ্চিত করেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে যাতে সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাটুকুও না থাকে। বিচারবিভাগ, শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিক প্রশাসন, এমনকী ব্যাঙ্কেও, নিজের গোষ্ঠীর লোকদের বসিয়ে তাদের হাতে অ-পছন্দের (অর্থাত্‌ অ-শিয়া) মানুষদের উপর অত্যাচার চালানোর বিরাট ক্ষমতা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন, সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক এবং দুর্নীতি-নিরোধক কমিশন: এদের নাকি এমন করে আগাপাশতলা তৈরি করেছেন যাতে আগামী একশো বছরে তার ফাঁক দিয়ে মাছি (অর্থাত্‌ কোনও সুন্নি) গলতে না পারে। মার্কিন বকুনি কাজ দেয়নি, কেননা চির-মার্কিন-শত্রু প্রতাপান্বিত প্রতিবেশী ইরানের কৃপাদৃষ্টি সতত সজাগ থেকেছে আল-মালিকির প্রতি।

বুঝতে অসুবিধে হয় না, আল-মালিকির ‘অপ’শাসনের বিরুদ্ধে কেন আইএসআইএস-এর এই দ্রুত উত্থান, আর কেন তার জঙ্গিত্বের বাড়াবাড়ি দেখেও দেশের জনসমাজের একটা বড় অংশের এমন ভক্তি-মিশ্রিত আত্মসমর্পণের ভাব। সাদ্দাম হুসেনের দল বাথিস্ট পার্টি বা তারিকা আল-নাক্শ্‌বান্দিয়া, জামাত আনসার আল-ইসলাম: এগুলি ইরাকের প্রধান সুন্নি দল। কিন্তু সুন্নি হলেও সামাজিক-রাজনৈতিক এবং ধর্মনৈতিক দিক দিয়ে এই জঙ্গি বাহিনীর সঙ্গে এদের অনেকটাই তফাত (বাথিস্টদের মধ্যে তো সুফি প্রভাব বেশ প্রকট, যার সঙ্গে জঙ্গি মৌলবাদের সহস্র যোজন দূরত্ব), অথচ আপাতত দেখা যাচ্ছে সকলেই আইএসআইএস-এর প্রতাপ মেনে নিতে রাজি। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল অধিকার করার পর নাকি নাক্শ্‌বন্দিদের কাছে নির্দেশ গিয়েছিল, শহরে যত সাদ্দাম হুসেনের ছবি লাগানো আছে, সব খুলে নিতে হবে। নাক্শ্‌ববন্দিরা তত্‌ক্ষণাত্‌ নির্দেশ পালন করেছে, কিন্তু প্রকাশ্যে এই চাপের কথা অস্বীকার করতেও তাদের দেরি হয়নি। জোর গলায় তারা বলেছে, এ সবই তুচ্ছ সামান্য পার্থিবতা, আসল বিষয়ে তো তারা জঙ্গিদের পাশেই আছে, সেটা হল, বর্তমান শাসকদের টেনে ক্ষমতাচ্যুত করা।

ইরাক জুড়ে আপাতত এই যে আপাত সুন্নি-ঐকমত্য এবং তার সঙ্গে সিরিয়ার শিয়া প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে জঙ্গি অভিযানের প্রসার, এই সুযোগেই উপরের ওই সরল ব্যাখ্যাবলি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছে। বুঝতে কষ্ট হয় না, সুন্নি-প্রধান সৌদি আরব তার সমস্ত সম্পদ নিয়ে যদি কোনও প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তা হলে তার সাফল্য আটকানো প্রায় অসম্ভব। সুতরাং ইরাকে রক্তপাত, ক্ষয়ক্ষতি, হানাহানির মধ্যে উঁকি দিচ্ছে আরও অনেক বড় এক সংকটের তমসা। সিরিয়ার গৃহচ্যুত পলাতকরা নাকি ইতিমধ্যে লেবাননের জনসংখ্যার দশ শতাংশ, স্বভাবতই তাদের মধ্যে সংঘর্ষপরায়ণতাও বেশ বেশি। এ দিকে ইরান নাকি তার শিয়া-বাহিনী তৈরি করছে ‘শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়বে’ বলে। তা হলে যদি শেষ পর্যন্ত সরল সমীকরণটারই জয় হয়? শিয়া-সুন্নি বিভাজনটাই যদি ছড়িয়ে পড়ে আরও? সৌদি ও প্যালেস্তাইনের সুন্নি ছত্রছায়ায় যদি সিরিয়া-লেবানন-ইরাকের জনসমাজ সংঘর্ষে নামতে চায়, কিংবা সংঘর্ষকারীদের সর্বতোভাবে সমর্থন জোগাতে রাজি থাকে? আর তাদের উল্টো দিকে যদি মরণপণ লড়াইয়ের শপথ কাজে লাগায় ইরান-সিরিয়া-ইরাকের শাসকদের পাল্টা বাহিনী, কী হতে চলেছে তা হলে?

নিশ্চয়ই তা হবে না। অত বড় সংকটে পৌঁছনোর আগে কেউ কোনও ভাবে অর্থাত্‌ সম্ভবত, সিরিয়া সংকটে অংশ না নিতে চেয়েও যেমন ওবামার মুখোজ্জ্বল হয়নি, ইরাক সংকটে ‘উপদেষ্টা’ পাঠিয়েও তাঁর মুখান্ধকার অবধারিত। তাঁর সামরিক উপদেষ্টাদের কোনও প্রয়োজনই ছিল না ইরাকে, ইরানের সামরিক উপদেশই আল-মালিকির কাছে সর্বোচ্চ, এটাই হয়তো প্রমাণ হবে। আসলে কোনও যুদ্ধ-অভিযান বা যুদ্ধ-উপদেশ নয়, প্রয়োজন ছিল কেবল রাজনৈতিক উপদেশের। কিছু জরুরি কাজ করতে ইরাকের বর্তমান সরকারকে রাজি করানো, কিংবা নতুন সরকার গড়ে তাদের দিয়ে সেগুলো করানো। কী সেই জরুরি কাজ? যেমন, ইরাকের শাসনব্যবস্থায় সর্বদলীয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠানগুলির এমন সংস্কার, যাতে বর্তমান ক্ষমতাহীন গোষ্ঠীগুলি আশ্বাস পায় যে, ভবিষ্যতে হঠাত্‌ তাদের উপর নির্যাতন নেমে আসবে না। সর্বোপরি, সামরিক বাহিনীকে একদলীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে সব স্তরে সব গোষ্ঠীর নিয়োগ নিশ্চিত করা। এক কথায়, অসাধ্য সাধন করা। পথ এই একটাই, নিঃসন্দেহে রাজনীতির পথ। মার্কিন কূটনীতিক ও রাজনীতিকরাও সেটা বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু সে কথা এই মুহূর্তে মুখ ফুটে বলার সাধ্য কারও নেই। তাঁদের প্রেসিডেন্টেরও না। মাঝখান থেকে সামরিক হুহুঙ্কারের প্রবল ঢেউয়ে তাই প্রতিদিনই আর একটু করে পিছু হটছে লেভান্ত্-এ নতুন কোনও শান্তিমুখী রাজনীতির সম্ভাবনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial semanti ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE