নবদ্বীপ: এ পার এবং ও পার
‘যা রে মাধাই জেনে আয় নদিয়ায় কী মধুর ধ্বনি শোনা যায়।’ পালাকীর্তনের লাইন দুটি মনে মনে গাইতে গাইতে রওনা হই নবদ্বীপ। কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে স্বরূপনগর ঘাট ত্রিশ পঁয়ত্রিশ মিনিট। সেখান থেকে এক দিকে যাওয়া যায় পুরোনো নবদ্বীপ, অন্য দিকে মায়াপুরধাম। ইদানীং পুরনো নবদ্বীপের কৌলীন্য কিছুটা বা ান। তুলনায় ভাগীরথীর এ পারে মায়াপুর-সহ চৈতন্যমহাপ্রভুর জন্মভিটে ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থান হয়ে উঠছে অন্যতম পর্যটন-আকর্ষণ। নবদ্বীপ বলতে নয়টি দ্বীপের সমষ্টিকে বোঝায়। ভাগীরথীর পূর্ব পারে ১) অন্তর্দ্বীপ ২) সীমন্তদ্বীপ ৩) গোদ্রুমদ্বীপ ৪) মধ্যদ্বীপ, পশ্চিম পারে ১) কোলদ্বীপ ২) ঋতুদ্বীপ
৩) জহ্নুদ্বীপ ৪) মোদদ্রুমদ্বীপ এবং ৫) রুদ্রদ্বীপ। পশ্চিমপারের রুদ্রদ্বীপের কিছুটা অংশ লুপ্ত, বাকি অংশের পশ্চিম দিক দিয়ে ভাগীরথী প্রবাহিত, ফলে রুদ্রদ্বীপের অবস্থান এখন গঙ্গার পূর্ব দিকে। প্রাচীন নবদ্বীপ ভাগীরথীর পূর্ব পারে, এবং ইদানীং ব্রাহ্মণপুকুর, বেলপুকুর, শ্রীমায়াপুর, বল্লালদিঘি, শ্রীনাথপুর, ভারুইডাঙ্গা, টোটা প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রসিদ্ধ।
ভাগীরথীর ও পারে সকাল সকাল গিয়ে মুখ্য দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর মধ্যে দেখে নেওয়া যায় রাধারানির মন্দির, মা মনসা ও গন্ধেশ্বরী মন্দির, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর মিলনমন্দির, সোনার গৌরাঙ্গ, পুড়ামাতলা ইত্যাদি। ভ্যানচালকেরা এই সব স্থান দেখিয়ে দেবেন মাথাপিছু চল্লিশ টাকা নিয়ে। একটু দামাদামিও চলতে পারে।
নদীর ও পারের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে চলে আসুন মায়াপুরধাম। এখান থেকেই কাছাকাছি বলে দর্শন করে নেওয়া যায় শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর জন্মস্থান, শ্রীবাস অঙ্গন, শ্রীঅদ্বৈতভবন, শ্রীলপ্রভুপাদের সমাধি মন্দির, শ্রীচাঁদকাজির সমাধি ও শ্রীরাধাকুণ্ড। আরও দূরবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলো দেখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। মায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দির প্রাঙ্গণ মুগ্ধ করে। মন্দিরের কার্যসূচি শুরু হয় ভোর চারটে তিরিশ মিনিটে মঙ্গল আরতির মাধ্যমে। শেষ হয় রাত আটটা পনেরো মিনিটে শয়ন আরতির মাধ্যমে। ভজনকুটিরে চলছে দিনরাত নামসংকীর্তন। মনে পড়ে, এই নামসংকীর্তন করার অপরাধেই নবদ্বীপের প্রাচীন শাসনকর্তা চাঁদকাজি অগ্নিশর্মা হয়ে জনৈক কীর্তনকারীর মৃদঙ্গ ভেঙে দিয়ে নামসংকীর্তন নিষিদ্ধ করেছিলেন। অথচ এই নামের গুণেই এই কাজি এবং জগাই ও মাধাইয়ের মতো বিপথগামীরাও শেষে শ্রীচৈতন্যের প্রেমের আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে পান উজ্জ্বল উদ্ধার। কাজি তো শ্রীচৈতন্যকে শেষে কথা দিয়েছিলেন তাঁর বংশধরদের কেউ কোনও দিন নামসংকীর্তন বন্ধ করবেন না। এখানে থেকেই দেখে নিন গোশালা, গুরুকুল, শ্রীলপ্রভুপাদের পুষ্পসমাধি মন্দির ও মিউজিয়াম, শ্রীরাধামাধবের মন্দির, শুনে নিন ভাগবত পাঠ ও ভগবদ্গীতার উপর আলোচনা। যদি এখানেই রাত্রিবাস করেন, তবে দেখতে পারেন ভিন্ন ভিন্ন আরতি।
স্বপন শর্মা। চাকদহ, নদিয়া
আলাদা করবেন না
জামাইষষ্ঠীর লোকায়ত ভাবনা ও জহর সরকারের (‘জামাই রহস্য’, ২৪-৫) লেখকের চিন্তার সঙ্গে আমি একমত। জামাইষষ্ঠী বলে যে রীতিটি বাঙালি সমাজের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় উৎসব বলে চিহ্নিত হয়েছে তার ভিত কোথায়? আমার মতে, সন্তানের মঙ্গলকামনায় মা ষষ্ঠীর আরাধনা মায়ের কাছে বিশেষ আকুতিভরা প্রার্থনা হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ‘জামাই’, যাঁর হাতে তিনি তাঁর আদরের নিধিকে সমর্পণ করেছেন, তাঁকে তুষ্ট রাখার জন্যই যেন জামাইষষ্ঠী উদ্যাপন। নাড়ি ছেঁড়া ধনের প্রতি যে টান, সেটা এর মধ্যে থাকে কি? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মেয়ের শ্বশুরবাড়ি তথা সেই বাড়ির বাবা-মা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের মন রাখার জন্য ‘জামাই বাবাজীবন’ ভুল ত্রুটি অন্যায় দেখেও নিজের বউকে নানা রকম ভর্ৎসনা করছে অথবা বউয়ের বাবা-মা তুলে নানা রকম কথা বলে তাকে মানসিক নিপীড়়ন করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এই ভাবে সে বাড়ির লোকের মনোরঞ্জন করে চলেছে। বিবাহিত জীবনের মধ্যে ঝগড়া উপস্থিত হচ্ছে, বা মেয়েটি অভিমানভরা হৃদয়ে চোখের জল ফেলছে। জামাই যদি বাড়ির ছেলে না-হয়ে উঠতে পারে, শ্বশুর শাশুড়িকে নিজের বাবা-মায়ের মতো সম্মান না-দিতে পারে সেখানে জামাইষষ্ঠী ব্যাপারটা প্রহসন বলেই বোধ হয়।
আর একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসে। বউ ষষ্ঠী বলে কোনও উৎসব কেন হয় না? পরের বাড়ির মেয়েকে নিজের বাড়ির মেয়ে বলে ভাবতে এবং সেই আসনে অধিষ্ঠিত করতে বেশির ভাগ পরিবারই মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয় বলে?
আগে বিবাহিত মেয়েরা ছিল নানা কারণে নিপীড়িতা। তার হাত থেকে সন্তান যাতে রক্ষা পায় সেই কামনায় জামাইয়ের নামে হত ষষ্ঠীর আরাধনা। আজ সে অবস্থা অনেকটা পালটেছে। বর্তমানে ছেলে-মেয়ে বলে পৃথক করে দেখা উচিত নয়। জামাই সন্তুষ্টির জন্য জামাইষষ্ঠী নামধারী প্রথার অবসান ঘটানো যেতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই যে, সংসারে এমন অনেক জামাই আছে যাঁরা কিন্তু তাঁর শ্বশুরবাড়িতে শুধুমাত্র জামাই নয়, নিজের ছেলের থেকেও অনেক বেশি এবং সেই জামাই ছাড়া শ্বশুরবাড়িও কোনও দায়িত্বপূর্ণ কাজে অগ্রসর হতে পারে না। আর সে ক্ষেত্রেও জামাইষষ্ঠীর মাধ্যমে জামাইকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করা উচিত নয়।
সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায়। কলকাতা-১৮
‘ষাট ষাট’
খেতে গিয়ে গলায় লাগলে কিংবা বিষম খেলে মা ঠাকুমারা বলতেন, ‘ষাট ষাট’। অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় (‘‘ষাঠ ষাঠ’ মানে’, সম্পাদক সমীপেষু, ৪-৬) ভাবতেন, শ্বাস বিভ্রাট বা বাঁকুড়ার আঞ্চলিক শব্দ ‘সটকে লাগা’ই ‘ষাট ষাট’ শব্দের উৎস। জহর সরকার বলেছেন, ষাট মানে ষষ্ঠী স্মরণ। আমার মনে হয়, ‘ষাট ষাট’-এর উৎস ‘সু-অস্তি’ বা স্বস্তি। অর্থাৎ, ভাল থেকো। শ্বাস আটকানো ছাড়া কোনও ব্যথা লাগলেও মা ঠাকুমারা ষাট ষাট বলতেন। শিশুরা পড়ে গেলে উঠিয়ে দিয়ে বলতেন, ষাট ষাট । বৈদিক ক্রিয়াকার্যে দান গ্রহণ করে গ্রহীতা বলতেন, ওঁ স্বস্তি: ভাল থেকো। শুভর প্রতীক চিহ্ন তাই স্বস্তিকা। প্রাক্বৈদিক এই চিহ্নের ব্রাহ্মণীকরণ হয়েছে।
আর ‘ষাট ষাট’ এর উল্টো প্রক্রিয়ায় উচ্চতর আর্যসমাজ থেকে সাধারণীকৃত হয়েছে।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী। কলকাতা-৭৪
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy