Advertisement
১১ মে ২০২৪
এই শর্তহীন গ্রহণ ছিল তাঁর ধর্ম
Sarada Devi

আজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৬৮তম জন্মতিথি

কেবল ভক্তের ভাবালুতায় নয়, সাধারণের অনুভবেও তিনি সকলের মা।

রমাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২১ ০১:২৭
Share: Save:

মা মানে অকৃত্রিম ভালবাসা। সব মায়েরাই তাঁদের সন্তানদের ভালবাসেন, তাদের ভাল ভাবে বেড়ে ওঠায় সবটুকু যত্ন ঢেলে দেন। কিন্তু নিজের সন্তানের প্রতি যেমন, অন্যের সন্তানের উপরেও কি তেমন ও ততটা ভালবাসা থাকে তাঁর? এক জন মা কি নিজের সন্তানের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যেরও মা হয়ে উঠতে পারেন? আর, যে নারীরা সন্তানজন্ম দেননি, দেন না, তাঁরাও কি অনিঃশেষ ভালবাসা দিয়ে ‘সত্য জননী’ হয়ে উঠতে পারেন?

উত্তরটা যে হ্যাঁ, তার দৃষ্টান্ত— সারদা দেবী। কেবল ভক্তের ভাবালুতায় নয়, সাধারণের অনুভবেও তিনি সকলের মা। এই সাধারণের মধ্যে সৎ ও অসৎ দুই-ই আছে, তিনি নিজমুখেই বলেছেন তিনি ‘সতেরও মা, অসতেরও’। খুব সহজ কথা, কিন্তু তার বিস্তারটি কঠিন। চারপাশের মায়েরা সতের সঙ্গে অসতেরও ভার নিতে এগিয়ে আসবেন কি? এই নারী, এবং মা— এগিয়ে এসেছিলেন। দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অসতের, পতিতের, স্খলিতের দায় নেওয়া প্রায় অসম্ভব কাজ। সারদা দেবী কিন্তু শরতের (স্বামী সারদানন্দ, রামকৃষ্ণ-শিষ্য, বিবেকানন্দের গুরুভাই) মা, ডাকাত আমজাদেরও মা। সে ডাকাত জেনেই, বা জেনেও। লোকচক্ষুতে যে দুর্জন, তারও মা থাকে। এই নারী বলেছিলেন, আমার ছেলে কাঁদলে আমাকেই তো ধুলোকাদা ঝেড়ে কোলে তুলে নিতে হবে। লক্ষণীয়, ধুলোকাদা-সহ নয়, ঝেড়ে। ধুলোকাদা ঝাড়া মানে অসতের ভাবটি মার্জনা করে, তাকে সংস্কৃত ও শীলিত করে গ্রহণ করা, এ ভাবে ভাবা যেতে পারে।

আজ থেকে একশো কুড়ি বছর আগে তিনি তিন বিদেশিনিকে (সারা বুল, মিস ম্যাকলাউড ও মার্গারেট নোবল, ভবিষ্যতের নিবেদিতা) ‘আমার মেয়েরা’ সম্বোধনে নিজের পাশে বসিয়েছিলেন তিনি, একাসনে ফল-মিষ্টি খেয়েছিলেন। মুখ্যত গ্রামীণ সমাজের বাসিন্দা, কেবল বাংলা অক্ষরটুকু পড়তে জানা এই নারী কোথা থেকে শিখলেন এই উদারতা? সে যুগে এ ছিল অভাবনীয় ঘটনা, স্বয়ং বিবেকানন্দ এ ঘটনা জেনে যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছিলেন। তাঁর খুশি হওয়ারই কথা। হৃদয়ের প্রসারই জীবনের লক্ষণ, আর ভালবাসা যে হেতু হৃদয়কে উন্মুক্ত করে, তাই ভালবাসাই জীবনের একমাত্র নিয়ম— বলেছিলেন যিনি, মায়ের এই ‘বৈপ্লবিক কাণ্ড’ দেখে তিনি খুশি না হয়ে পারেন?

জয়রামবাটীর গোয়ালঘরে গোবিন্দ নামে বছর নয়-দশের এক বালক কাজ করত। খোসপাঁচড়ার যন্ত্রণায় রাতে কাতর হয়ে কাঁদছিল সে, কান্না শুনে সারদা দেবীও ঘুমোতে পারেননি। ভোর হতে না হতে তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে এসে স্বহস্তে নিমপাতা-হলুদ বেটে লাগিয়ে দেন। তাতে ছেলেটিরও আরাম, মায়েরও শান্তি। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী লিখেছেন, ‘‘উভয়ের মুখ দেখিয়া কথাবার্তা শুনিয়া কে বলিবে— নিজের ছেলে নয়?’’ বাগবাজারে ‘উদ্বোধন’ বাড়িতে এক ভক্ত মহিলার শিশুকন্যা ঘুমন্ত অবস্থায় মায়ের কম্বল নোংরা করে ফেললে, সারদা দেবী কারও আপত্তি না শুনে নিজেই তা ধুয়ে আনলেন: ‘কেন ধোব না? ও কি আমার পর?’

প্রখ্যাত নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ জয়রামবাটীতে থাকার সময় এক দিন লক্ষ করেন, তাঁর বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় মা নিজে সাবান দিয়ে কেচে, শুকোলে পরে বিছানায় পেতে দেন। গিরিশ লিখেছেন: ‘‘মার অপার স্নেহের কথা ভাবিয়া হৃদয় আনন্দে আপ্লুত হইয়া উঠিল।’’ কলকাতা থেকে আসা ভক্তেরা সকালে উঠেই চা-পানে অভ্যস্ত। দেখা যেত, বাতের ব্যথায় কাবু সারদা দেবী পা টেনে টেনে চলেছেন, পড়শির বাড়ি থেকে চায়ের জন্য দুধ আনতে, ছেলেরা চা খাবে।

চেনা-অচেনা সকলের জন্য ভালবাসার অসংখ্য দৃষ্টান্ত তাঁর জীবন জুড়ে ব্যাপ্ত। উদ্বোধন-এর এক কর্মী চন্দ্রমোহন দত্তের পূর্ববঙ্গের বাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তিনি সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকতেন সেই নিয়ে। মা তা শুনে চন্দ্রমোহনের হাতে টাকা দিয়ে দেশে পাঠানোর সময় বললেন, ‘‘এতে তোমার পথের খরচ আর বাড়ি তৈরির খরচ, সব হয়ে যাবে।’’ বিপথগামিনী, সমাজ-স্বজনের কাছে অনাদৃতা একটি মেয়ে মায়ের কাছে এসে হাজির হল, মা বললেন, ‘‘ভয় কী মা, তুমিও যে আমার মেয়ে।’’ সমবেত অন্য মহিলাদের চোখে তখন সন্দেহ, ভ্রুকুটি। এক জন বলে বসলেন, এ এখানে এলে শ্রীরামকৃষ্ণের এক বড় গৃহী ভক্তের স্ত্রী আর এখানে আসবেন না জানিয়েছেন। সারদা দেবী কিন্তু গ্রাহ্য করেননি, অপরিসীম দার্ঢ্যে উত্তর দিয়েছেন, ‘‘কেউ যদি না আসে না আসুক, কিন্তু ও আমার কাছে আসবে।’’

এই শর্তহীন গ্রহণ কঠিন এক কাজ। পরিবার, বা সমষ্টির পরিসরে বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও আমরা এই গ্রহিষ্ণুতা আচরণ দূরস্থান, ভাবতেও পারি না। অথচ উনিশ শতকের মধ্যভাগে জন্মানো, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও নাগরিক সংস্কৃতির স্পর্শরহিত এক নারীর জীবনচর্যায় মিশে ছিল এই ‘ইনক্লুশন’, চিরগ্রহণের বোধ। তা যুক্তিহীন আবেগসর্বস্ব ছিল না, ছিল বাস্তবমুখী। সেই মাতৃত্বের বোধ ঘরের নিগৃহীত বেড়ালছানাটিকেও আদরে বাঁচায়, ব্রিটিশের তাড়া খাওয়া তরুণ বিপ্লবীকেও আশ্রয় দেয়, রক্ষা করে। সে মাতৃত্ব সদ্য-বিধবা তরুণীর সহমর্মী হয়ে গলা জড়িয়ে কাঁদে, আবার বিয়ে না-হওয়া গরিব মেয়ের মাকে শিখিয়ে দেয় জীবনের পাঠ: ‘‘নিবেদিতার স্কুলে দিয়ে দিও— লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।’’ এ রকম মা হতে পারা বড় সহজ কথা নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sarada Devi Birthday
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE