Advertisement
E-Paper

এপ্রিল ১৯৯২: মুক্তি পেল ‘তোমাকে চাই’, বাকিটা...

গ ত শতকের সত্তর ও আশির দশক। জার্মানির পরিচ্ছন্ন পরিপাটি কোলন শহরে আমরা কয়েক জন যুবকযুবতী ভীষণ ব্যস্ত। ফারুক, শাজাহান, নাজমুন, ইন্দিরা, শুভ্রা, আমি ও সুমন জার্মান বেতার তরঙ্গ বা ‘দয়েচে ভেলে’-র বাংলা অনুষ্ঠান পরিচালনা করছি।

শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৫৯
গানওলা: নিজের বাড়িতে সুমন চট্টোপাধ্যায়। নভেম্বর, ১৯৯২

গানওলা: নিজের বাড়িতে সুমন চট্টোপাধ্যায়। নভেম্বর, ১৯৯২

গ ত শতকের সত্তর ও আশির দশক। জার্মানির পরিচ্ছন্ন পরিপাটি কোলন শহরে আমরা কয়েক জন যুবকযুবতী ভীষণ ব্যস্ত। ফারুক, শাজাহান, নাজমুন, ইন্দিরা, শুভ্রা, আমি ও সুমন জার্মান বেতার তরঙ্গ বা ‘দয়েচে ভেলে’-র বাংলা অনুষ্ঠান পরিচালনা করছি। সারা দিন ধরে বেতার-সাংবাদিকের কাজ, তার পর সন্ধ্যায় জমাট আড্ডা আর বাঙালি খানা। এ সবের মধ্যে অফিসে বা নাজমুনের বাড়িতে গানের আসর বসত, আর সেই আসরে মধ্যমণি ছিল সুমন। বিয়ার বা মদিরা সহযোগে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গাইতে আমরা সে সময়ে নস্টালজিয়া বা স্মৃতিতিয়াসা দ্বারা আক্রান্ত। সুমনই হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটার পর একটা গান গাইত, কিন্তু তখনও আমরা এক লহমার জন্যও ভাবিনি যে এই চারণ ভবিষ্যতে ঢাকা ও কলকাতাকে গানে সুরে নিমগ্ন করবে। হয়তো বা আড়ালে, আমাদের না জানিয়েই সুমন তখনই গান লিখত। আমরা এই সম্ভাব্য প্রচেষ্টা সম্পর্কে কোনও কিছু জানতামই না।

দয়েচে ভেলে-তে সহকর্মীদের জন্মদিবস পালন করা হত ঘটা করে। কেক কাটা হত এবং তার সঙ্গে শ্যাম্পেন ও মদিরা। এমনই একটি অনুষ্ঠানে আমি যাকে বলে ‘আউট’ হয়ে গিয়েছিলাম। আর সেই দিনেই আমার ভাগে পড়েছিল রাজনৈতিক ভাষ্য লেখার কাজটি। আমি তখন বস-এর টেবিলে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে রয়েছি। প্রশ্ন উঠল কে লিখবে ভাষ্যটি। সুমনই এগিয়ে এল, বলল ‘শুভ, কিছু ভাবিস না, আমি তোর কাজটা করে দেব।’ আমরা এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলাম সেই পর্বে, তবুও এক বারও ভাবিনি, রাজনৈতিক ভাষ্যকার সুমনই এক দিন লিখবে ও গাইবে ‘তোমাকে চাই’।

আরও পড়ুন:ছকভাঙা রবীন্দ্রগান প্রাণ ঢালল আনন্দ সন্ধ্যায়

তার পর আমরা ফিরে আসি কলকাতায়। আমি পুনরায় সাংবাদিকতার কাজ শুরু করি, সুমন তখন গান রচনায় নিবেদিত। সুমন, তার প্রথম প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে (শিশির মঞ্চে, রবিবার সকালে) বুঝিয়ে দিল যে, সে আদ্যন্ত নবীন এবং প্রথাভঙ্গকারী। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর মমতাশঙ্কর সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, এবং অন্য শ্রোতাদের মতো তাঁরাও সঙ্গীত পরিবেশনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিলেন। গান শোনার পর আমি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ একটি মূল্যায়ন লিখি, যার শিরোনাম ছিল, ‘ক্যালকাটা ফাইন্ডস ইটস ত্রুবাদুর’। সেই অনুষ্ঠানেই সুমন প্রথম গেয়েছিল ‘তোমাকে চাই’। গানটির সব কিছু— চিন্তাচেতনা, ভাষা, আবহসঙ্গীত, সুর-তাল-লয়-বাণী আমাদের মোহিত ও আন্দোলিত করেছিল। আমাদের কোনও সন্দেহ ছিল না যে, আমরা একেবারে আগাপাশতলা এক নতুন শিল্পীকে পেয়েছি, যে শুধুই গায়ক নয়, একশো শতাংশ পারফর্মার।

দয়িতা বা প্রেমিকাকে ‘কমরেড-ইন-আর্মস’ বলে সম্বোধন করেছেন সুমনের আগেও একাধিক বিশিষ্ট কবি। ফ্রান্সের কবিদ্বয় পল এলুয়ার ও লুই আঁরাগ, আমাদের বিষ্ণু দে— দয়িতাকেই সংগ্রামের সাথী করেছিলেন। স্মরণে আনুন বিষ্ণু দে’র সেই অনশ্বর পঙ্‌ক্তি:

সে সূর্যোদয়ে তুমিই তো ফুল/ কিংবা কালের বাগানে আমার ঘুমভাঙানিয়া মালিনী।

কিন্তু তাঁরা শুধু কবিতাই লিখেছিলেন, তার বেশি কিছু নয়। আর সুমন একই বিপ্লবী বাণী ও সত্যকে জীবন্ত করে তুলেছে তাঁর গানে। এই গানটি গাওয়ার সময় মঞ্চ যেন আন্দোলিত হয়, পরিবেশ উদ্দীপিত হয়ে ওঠে, আর আমরা বিমূঢ় শ্রোতারা আঁজলা ভরে সঙ্গীতটিকে গ্রহণ করি।

আমাদের দুজনের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের পিছনে অবশ্যই কারণ আছে। এক, আমরা দুজনেই বই পড়তে খুব ভালবাসি, এবং কয়েক জন লেখকের বই আমাদের প্রাণিত করে। এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ হল হার্বার্ট মারকিউসে। এই মার্কসবাদী নন্দনতত্ত্ববিদের লেখা ‘দি এসথেটিক ডাইমেনশন’ আমাদের প্রিয় বই। দুই, দুজনেই সাম্প্রদায়িকতার ঘোরতর বিরোধী এবং স্পষ্টতই সাম্যবাদের প্রবক্তা। কিন্তু একটি বিষয়ে আমাদের মত ভিন্ন। বেশ কিছু দিন আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ার জন্য গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে আমি সুমনকে ‘কবি’ বলেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি করে সুমন জানিয়েছিল, ‘না রে না রে শুভ, আমি কবি নই, আমি শুধু গীতিকার।’

আমি মনে করি, সুমন শুধু গীতিকার নয়, যেমন বব ডিলানও নিছক গীতিকার নন। বহু দৃষ্টান্ত থেকে মাত্র দুটি তুলে ধরছি। প্রথমটি তাঁর সেই অনবদ্য গান বা কবিতাটি, জাতিস্মর, যার প্রথম দুটি পঙ্‌ক্তি হল: ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনও দাবিদাওয়া/ এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া।’ আর দ্বিতীয়টি, অবশ্যই, ‘তোমাকে চাই’। সুমনের অসংখ্য ভক্ত এই দুটি গানকে স্মরণে রেখে কী দাবি করবেন— সুমন মূলত কবি, না শুধুই গীতিকার? আমি বলব ‘কবি’। সুমনের অনুরাগীদের মধ্যেও সম্ভবত দুটি গোষ্ঠী রয়েছে। একটি গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে প্রস্তুত যে সুমন আদতে এক জন কবি। দ্বিতীয় গোষ্ঠী তাঁকে গীতিকার হিসেবে সম্মান দিতে উন্মুখ। পরবাসে, কোলনে অবশ্য এই ধরনের কোনও বিভাজন ছিল না, কারণ তখন সুমন মুখ্যত অন্যদের লেখা গান গাইত।

কবিতার চরিত্র মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রসিদ্ধ ইতালীয় সমালোচক গালভানো দেল্লা ভোলপে বলেছেন, কবিতার বৈশিষ্ট্য নিহিত তার ‘ফাইন একসেস’ বা সুচারু আধিক্যে। এই সুচারু আধিক্যই ছড়িয়ে আছে তার গানে। শুধু ‘তোমাকে চাই’-এই নয়, অন্য বহু গানেও আমরা এই আধিক্যের সম্মুখীন হই। উপরন্তু, এই ফাইন একসেস-এর কল্যাণেই একটি স্তবক বা পঙ্ক্তিগুচ্ছ অনায়াসে বিস্তার লাভ করে অন্য স্তবকে। এই স্বতশ্চল স্রোতের প্রবাহ আমাদের মুগ্ধ করে, যখন সুমন গেয়ে ওঠে ‘গড়িয়াহাটার মোড়, মিনি মিনি বাস বাস...।’ বলতে দ্বিধা নেই, কলকাতার এ রকম সুতীক্ষ্ণ কাব্যময় বিস্তার একমাত্র সুমনের কবিতা বা গানেই হয়েছে। অন্য এক নামজাদা তাত্ত্বিক রোমান জেকবসন বলেছেন, কবিতার ভাষা প্রচলিত ভাষা থেকে নিজেকে ভিন্ন করে নেয় এবং এই নতুন ও ভিন্ন ভাষা প্রয়োগের ভিত্তির উপরেই কবিতা দাঁড়িয়ে থাকে। বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যখনই সুমন গেয়ে ওঠে ‘সব আমাদের জন্য’, তখনই আমরা এই ভিন্ন ভাষাস্রোতে অবগাহন করি।

আসলে কবিতা কখন গান হয়ে ওঠে এবং গান কখন কবিতা হয়, আমরা, সত্যি বলতে, জানি না। এই দুই সৃজনের ভিতর কোনও সুস্পষ্ট সীমারেখা নেই। এদের অন্তরঙ্গ সাযুজ্যকে স্মরণে রেখেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘আমি কবি সংগীতের ইন্দ্রজাল নিয়ে আসি চলে/ মৃত্তিকার কোলে।’ সুমনও আদ্যন্ত কবি, তাই রবীন্দ্রনাথের কথিত সংগীতের ইন্দ্রজাল সে এই নশ্বর বিশ্বে বিছিয়ে দিয়েছে। আমি আদৌ দাবি করব না যে সুমনের প্রত্যেকটি গান কবিতার সার্থক স্তরে উন্নীত, রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানও কবিতা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই গীতিকার সুমন হয়ে উঠেছে কবি সুমন। বিশেষ করে ‘তোমাকে চাই’-এর প্যাশন ও মোহময় বিস্তার আমাদের অজান্তেই গানটিকে কবিতা করে তোলে, এবং আমরা থেকে থেকে পঙ্‌ক্তিগুলি উচ্চারণ করি সুর বিনা-ই।

একই অনুভব আমাদের মথিত করে, যখন ‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই’ গানটিতে একটির পর একটি মরমি চিত্রকল্প ভেসে আসতে থাকে নিজস্ব নিভৃত নিয়মে। আমার এই দাবির প্রমাণও রয়েছে। প্রমাণটি হল, সুমনের সহস্র অনুরাগী শুধুমাত্র তাঁর গানের সিডি কেনেন না, তাঁরা মুদ্রিত ও প্রকাশিত গানের বইগুলিও ক্রয় করেন। অন্য ভাবে বললে, এই বইগুলির একটি স্বতন্ত্র কাব্যমূল্য রয়েছে। কবিতার উৎসভূমি হল লিরিক, এবং পুরাকালে এই লিরিক সংগীতের অবয়বে পরিবেশন করা হত। বাউল, চারণ, ত্রুবাদুর, চ্যাসোনিয়ার— গান ও কবিতাকে সেই অতীত কাল থেকেই মিলিয়ে দিয়েছেন অনায়াস স্বতঃস্ফূর্ততায়। সুমন এই ঐতিহ্যের প্রতিনিধি।

Kabir Suman Tomake Chai Singer Song
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy