Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অঞ্জন থেকে অঞ্জনা, বিয়েও হল ধুমধাম করে

প্রতিটি সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে উঠেছে ঝড়। কিন্তু লড়াই কিছুতেই গতি হারায়নি। প্রতিজ্ঞার বুনোটে তখন বাঁধন আরও শক্ত হয়েছে। হার না মানা প্রেমের কথা শোনাচ্ছেন জিনাত রেহেনা ইসলামকিন্তু শ্বশুরবাড়ি? সেখানে বলতে গেলে  তো সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। রাহুল সাহস করে মাকে জানায় সব। অঞ্জনার বধূবরণ হয় নিয়ম মেনে।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২৩
Share: Save:

বন্ধুত্বের বয়স মাত্র এক বছর। ফেসবুকেই আলাপ। অঞ্জন আর রাহুলের গল্প এমনি করেই শুরু। অঞ্জন (নাম পরিবর্তিত) মনে মনে মেয়ে। দু’জনের নিপাট বন্ধুত্ব। অঞ্জনের জীবন জুড়ে নানা রূপান্তর। হাজার বঞ্চনা নিয়ে চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা। রাতভর দুঃখের মুহূর্ত বিনিময়। এমনি করেই দু’জনের মন এক তারে বাঁধা পড়ল। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে তুখোড় রেজাল্ট করা রাহুল (নাম পরিবর্তিত) বুঝতে পারে, সে প্রেমে পড়েছে। পরিস্থিতি বুঝতে দেরি হয় না অঞ্জনের। চটজলদি রূপান্তর। অঞ্জন হয়ে গেল অঞ্জনা। সে শর্ত দেয় রাহুলকে। একসঙ্গে থাকতে হবে এক বছর। বুঝতে হবে কম্প্যাটিবিলিটির পারদ কত দূর। তার পরে বিয়ের সিদ্ধান্ত। অঞ্জনা এক বছরেই রাহুলকে ফুল মার্কস দেয়। বিয়ের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। কিন্তু বাধ সাধে ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, পড়শি ও পরিবার। চলতে থাকে আইনি পরামর্শ। শেষতক স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে।

কিন্তু শ্বশুরবাড়ি? সেখানে বলতে গেলে তো সব ঘেঁটে ঘ হয়ে যাবে। রাহুল সাহস করে মাকে জানায় সব। অঞ্জনার বধূবরণ হয় নিয়ম মেনে। ধুমধাম করে নববধূ পা রাখে শ্বশুরবাড়িতে। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় থিতু হয় অঞ্জনা।

প্রেম এক আত্মিক বাঁধন। জগৎ সংসারের অলৌকিক উপলব্ধি। ভালবাসা জীবনের বন্ধু। তাকে প্রতিনিয়ত ছুঁয়ে থাকতে কেমন লাগে? অঞ্জনা হাসে, ‘‘স্বপ্ন সত্যি শুধু নয়, অনেক পেয়েছি।’’ ফেলে আসা দিনের কথা ভেবে ঝাপসা হয় অঞ্জনার চোখ। সম্পর্কের শেকড় ছিনিয়ে নিয়েছে অনেক কিছু। তবুও পরাভবের জীবন নয়। তারা স্পর্শ করেছে গভীর বিশ্বাসের সেই লক্ষ্যমাত্রা। প্রতিটি সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে উঠেছে ঝড়। কিন্তু লড়াই কিছুতেই গতি হারায়নি। প্রতিজ্ঞার বুনোটে তখন বাঁধন আরও শক্ত হয়েছে। ভরা ভাদ্রে ভাড়া বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয় দু’জনকে। নিজেদের লক্ষ্য নির্মাণ করতে অনেক কাটা–ছেঁড়া করতে হয়। এক অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম নিয়েও অঞ্জনাকে ছাড়তে হয় মা-বাবা। ভাই সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। আমেরিকা যাচ্ছে। কিন্তু দেখা করার উপায় নেই। নিজেকে আবিষ্কার করে পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে নাড়ির সম্পর্ক। কিন্তু বিচ্ছেদ, হাহাকার পেরিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে প্রেম। সম্পর্ক কখনও ব্যাখা, ব্যাকরণ, উচিত- অনুচিত মানে না। অনুভূতির প্রশ্রয় আর বিশ্বাসে কালজয়ী হয় প্রেম। দুই অসীম জগতকে দু’হাতে আঁকড়ে থাকার বিরাট অনুভুতি অঞ্জনা- রাহুলের।

অঞ্জনার কথায়, ‘‘হরমোন থেরাপির বাইরে প্রথমেই অ্যান্টি এজিং আর স্কিন লাইটেনিং করাতে হয়েছে। বাকি আছে কসমেটিক সার্জারি করে জ-লাইন ঠিক করা। ভ্যাজাইনোপ্লাস্টি করার পরে আর সিলিকন ব্রেস্টের কথা ভাবিনি। রাহুলের একটিই কথা ছিল, ‘তোকে ভালোবাসি, তোর আত্মাকে ভালবাসি। শারীরিক গঠন আমার কাছে গৌণ।’ কিন্তু আমার মা হওয়ার বড় স্বাদ। তা থেকেই পরপর সাজাই প্রতিটি পদক্ষেপ। এ ক্ষেত্রে রাহুলের কোনও বায়না ছিল না।’’

ভালবাসা কি বিয়ের থেকেও জ্যান্ত? অঞ্জনা জানায়, একটা মানুষকে জানা, তার স্বপ্নকে জানা, দু’জনের স্বপ্নকে সমান ভাবে সঙ্গ দেওয়া হল ভালবাসা। স্বপ্ন প্রতিষ্ঠা নিয়ে বরাবর চলে নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ। নানা টানাপড়েন পেরিয়ে নিজেদের চিনে নেওয়ার পালা সাঙ্গ করার অন্তিমে বিয়ে। ভালবাসা দু’টি মানুষের নিজস্ব জগৎ। কিন্তু বিয়ে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নেওয়া মহাজগতের সংসার। একক থেকে সমগ্রে প্রবেশ করা। আসলে প্রেম এক চিরন্তন উপলব্ধি। তাই এর কোনও গণ্ডি নেই। নির্দিষ্ট শব্দবন্ধনীর ছকে একে ফেলা যায়নি আজও। এক কথায় কেউ জবাব দিতে পারেনি প্রেম কী? অঞ্জনার মতে, প্রেম এক কথায় আশ্রয়। তা দিতে ও নিতে যারা সক্ষম তারাই জীবনের সব যুদ্ধে জয়ী।

রাহুল মুখ খোলে এ বার। অঞ্জনা যে আজও তার প্রিয় বন্ধু সেটাই সে বলে। তার কথায়, ‘‘বন্ধুর মধ্যে স্ত্রীকে খুঁজে পাওয়া বেশ গর্বের।’’ নানা পারিবারিক ও পেশাগত বিষয়ে অঞ্জনা দক্ষতার সঙ্গে সঙ্ঘ দেয়। শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত রান্না করে। পরিপাটি করে ঘর গুছিয়ে রাখে। এমনকি নিজের সন্তানের জন্য আগাম পরিকল্পনা ছকে ফেলেছে সে। বাচ্চার জন্য আলাদা করে কেনা হচ্ছে ফ্ল্যাট। দু’জনেরই দাবি, ‘‘প্রেমকে সমাজে, পরিবারে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে এত দূর অমসৃণ পথের ওপর পা চালিয়ে আসতে গায়ে লেগেছে ঘাম ও রক্তের দাগ। কিন্তু দিনের শেষে পথের খোঁজ চলে ঘরে ফেরার জন্য। সেই ঘর একান্ত নিজেদের পরিশ্রমের নির্মাণ। সেখানে সব রক্তচক্ষুর দৃষ্টি অবনত।’’

অঞ্জনা-রাহুলরা চায় বোঝামুক্ত এক ঝকঝকে জীবন। যেখানে শান্ত দিঘির জলে যেন দেখা যায় এক গোটা লাল সূর্য। মাছের সোনালি পিঠে ঠিকরে পড়া রশ্মিতে যেন গোনা যায় গায়ে লেগে থাকা সুসজ্জিত প্রতিটি আঁশ। সত্যকে লুকিয়ে রাখা কখনও জীবনের ধর্ম হতে পারে না। নিজেদের পরিচয় আড়াল বড়ই বিপত্তির। কিন্তু সমাজ নিরীহ প্রেমিকদের আইডেন্টেটি ক্রাইসিস উপহার দিয়েছে। নাম বদলে, জায়গা বদলে তারা যাপন করছে এক দর-কষাকষির জীবন। এক কথায়, বেনামি বনবাস। এই কয়েদ থেকে তারা নিষ্কৃতি চায়।

যার কাছে যেমন ভাবে সম্পর্ক ধরা দেয় সেটাই তার কাছে চূড়ান্ত। সমাজ চোরাবালির উপরে নয়, বাস্তবের উপর দাঁড়ায়। বাস্তব ভরসা করে পুঞ্জিত অভিজ্ঞতায়। প্রেম কোথাও না কোথাও সেই বাস্তবের ভিতে ইট সাজিয়ে চলেছে দু’হাতে। প্রেমের কোনও ধর্ম নেই, দেশ নেই, সমাজ নেই। মানুষের অপরাধ জরিপ করার ক্ষেত্রে প্রেম কখনও মাপকাঠি হতে পারে না। তাই প্রেমের জন্য কেউ দোষী সাব্যস্ত হতে পারে না। প্রতিরোধের দেওয়াল তুলে তাদের সাজা দেওয়ার ভাবনা অন্য এক অন্যায়ের জন্ম দেয়। ভারসাম্য অগোচরে বদলে যায় বৈষম্যে।

নিষেধের পাহাড় পেরিয়ে প্রেম এক সময়য় খুঁজে নেয় নিজের জগৎ। চূড়ায় উঠে ঘোষণা করে, জীবন একটি। মন একটি। লক্ষ্যও একটি—স্বপ্ন সাকার করা। ভুল হয় বার বার। কিন্তু ঠিক পথে সাহস করে নিজের চূড়ান্ত মত প্রতিষ্ঠা করতে হয় এক বারই। জন্ম যদি সৃষ্টির লক্ষ্য হয় তবে প্রেম জীবনের ধর্ম। বিশ্বের সব উন্নত দেশ ভালবাসায় প্রথা ভেঙেছে। নানা জটিলতা পেরিয়ে নিজেদের মতো করে সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়েছে মানুষ। প্রথা ভেঙে যদি মুক্তি চায় অঞ্জনা-রাহুল তাতে অভিমান কীসের?

যন্ত্রণাবিদ্ধ ক্লান্ত জীবন কখনও কাম্য নয়। জরুরি স্বপ্নের মুক্তি, বিশ্বাসের মুক্তি। সত্য ও সুন্দরের মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়াই তো জীবনের শেষ কথা। এই অমলিন চিরায়ত মুহূর্ত আগামীর জন্য বাঁচিয়ে রাখা কর্তব্য। কালিমালিপ্ত করা নয়, দৃষ্টির প্রসার প্রয়োজন। শিক্ষা সেই সাধনাকেই প্রশ্রয় দেয়। অধিকারের শেষে থাকে লড়াই। চ্যালেঞ্জ যারা নেয় তারা অসাধারণ। তাই জীবনে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার জন্য বেড়া ভাঙে কিছু মানুষ। দূরে ঠেলে ফেলা নয়, হাতে হাত মিলিয়ে তাদের সঙ্গ দেওয়া জরুরি। হেরে যাওয়া, মুখ ফেরানো জীবন থেকে সকলকে মুক্তি দিতে পারে একমাত্র প্রেম। তাই প্রেমের পূজারিরা আদরের। প্রেমে আক্রোশ প্রদর্শন নয়। পরম্পরার দোহাই দিয়ে নুড়ি সাজানো নয়। সত্যের পথে কাঁটা নয়, থরে থরে সাজানো থাকুক ফুল। এই আনন্দের পরম মুহূর্তে রাজা-ফকির, জায়গীরদার সব এক। ভালবাসার দিন প্রতিদিন। তবে একটি দিন শুধু তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখা। নিজের পছন্দের, একান্ত ভালবাসার নক্ষত্রটাকে ফিরে ফিরে দেখা।

লেখক রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুলের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Wedding Gender Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE