Advertisement
০৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আমার নিমন্ত্রণ

কখন কেন যে তাঁর মন ভাল হয়ে যায়, রাসকিন বন্ড নিজেও জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। ওটাই তাঁর স্বভাব। আপনি আরও অনেক দিন থাকুন, ওই মেঘ-পাহাড়ের ওপরে, নিজের জায়গায়, নিজের মতো করে।সত্তরের দশকে ‘দ্য সেনশুয়ালিস্ট’ নামে একটি গল্প লিখে অশ্লীলতার দায়ে পড়েছিলেন রাসকিন বন্ড। মামলার ফল শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষেই যায়, তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে বিচারপতি দীর্ঘ রায় দিয়েছিলেন। যিনি মামলা ঠুকেছিলেন তিনি অবশ্য রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। এ-সব নিয়ে তখন এবং পরে নানান পত্রপত্রিকায় লেখালিখি হয়েছে। রাসকিন বন্ড নিজেও হয়তো লিখেছেন, ঠিক জানি না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি সেই ঘটনার প্রসঙ্গে একটি গল্প শুনিয়েছেন।

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০০:৫৩
Share: Save:

সত্তরের দশকে ‘দ্য সেনশুয়ালিস্ট’ নামে একটি গল্প লিখে অশ্লীলতার দায়ে পড়েছিলেন রাসকিন বন্ড। মামলার ফল শেষ পর্যন্ত তাঁর পক্ষেই যায়, তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে বিচারপতি দীর্ঘ রায় দিয়েছিলেন। যিনি মামলা ঠুকেছিলেন তিনি অবশ্য রায় ঘোষণার আগেই মারা যান। এ-সব নিয়ে তখন এবং পরে নানান পত্রপত্রিকায় লেখালিখি হয়েছে। রাসকিন বন্ড নিজেও হয়তো লিখেছেন, ঠিক জানি না। কিন্তু সম্প্রতি তিনি সেই ঘটনার প্রসঙ্গে একটি গল্প শুনিয়েছেন। ফৌজদারি মামলা বলে কথা, পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে, গোলগাল চেহারার শান্তশিষ্ট মানুষটি থানার বারান্দায় বেঞ্চিতে বসে আছেন, বন্ধুরা এসে জামিন দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। মনটা অস্থির, ‘গ্রেফতার হওয়া কারও পক্ষেই সুখের নয়, তা ছাড়া গ্রেফতারি পরওয়ানা পড়তে মোটে ভাল লাগে না, এক গোয়েন্দা কাহিনিতে ছাড়া।’ হঠাত্‌ চোখে পড়ল, গুটিকয়েক পাখি দেওয়ালের কোণে একটা খাঁজের মধ্যে বাসা বানাচ্ছে, খড়কুটো নিয়ে আসছে কোথা কোথা থেকে, সেগুলো রেখে আবার উড়ে যাচ্ছে, আবার আসছে, মহা ব্যস্ত তারা। নিতান্তই আটপৌরে ব্যাপার, কিন্তু সেই কারণেই এই দৃশ্য দেখে মনটা সুস্থির হল। এই যে জগত্‌সংসার ঠিকঠাক চলছে, পাখিগুলো এক মনে নিজেদের কাজ করছে, এতে খুব একটা ভরসা পাওয়া গেল। একটু পরেই এক পুলিশ অফিসার এসে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেলেন, একটা ফর্ম ভরতে বললেন। রাসকিন একটু অন্যমনস্ক ভাবেই তাঁকে বললেন, ‘বারান্দায় পাখিগুলো কেমন বাসা বানাচ্ছে, দেখেছেন?’ পুলিশটি অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বললেন না, ‘নিশ্চয়ই ভাবলেন আমার মাথার গোলমাল আছে, জেল নয়, আমাকে অ্যাসাইলামে পাঠানো উচিত।’ কিন্তু তাঁর শূন্য দৃষ্টি দেখে রাসকিন বন্ড বুঝলেন, ‘এ মানুষটার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ, কারণ এ বেচারি এত তাড়াতাড়ি এবং এত সহজে ভরসা জোগাড় করতে পারবে না।’

মনটা কোনও কারণে অস্থির হলে যাঁদের কাছে ভরসা খুঁজি, রাসকিন বন্ড তাঁদের প্রথম সারিতে। ক’দিন আগে হাতে এল তাঁর লেখার নতুন একটি সংকলন: আ বুক অব সিম্প্‌ল লিভিং (প্রকাশক: স্পিকিং টাইগার)। ছোট্ট একটুখানি বই, কচি-কলাপাতা মলাটে একটি সরু আঁকাবাঁকা রেখা, পাহাড়ি রাস্তা হতে পারে, টেলিগ্রাফের তারও হতে পারে, সেই রেখায় পা রেখে মুখোমুখি দুটি পাখি, একটি সামনের দিকে উদাসীন চেয়ে আছে, অন্যটি তার মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে। পাতা ওল্টালে, উল্টে গেলে ছোট ছোট লেখা, বেশির ভাগই এক বা দুই পৃষ্ঠার, কোনও কোনওটি একটু বড়, অনেকগুলি কয়েক লাইনমাত্র, বাকি পাতা নিপাট সাদা, সেখানে দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে দু’দণ্ড গড়িয়ে নেওয়া যায়। মুসৌরি, থুড়ি, মুসুরি-র ওপরে ল্যান্ডোর-এর নিভৃতে রাসকিন বন্ডের পঞ্চাশ বছরের বসতি, নিজের সংসার নেই, কিন্তু নিজের চার পাশে দিব্যি সংসার তৈরি করে নিয়েছেন সেই কবে, গেরস্থালি ক্রমশ ডালপালা মেলেছে। এখন, তাঁর এই একাশি বছরে, অল্প কিছু দৈনন্দিন সামগ্রী নিয়ে পরিতৃপ্ত নিরাভরণ বাড়িটিতে সবই পুরনো, ‘শুধু আমিই ছেলেমানুষ।’ এই তো সে দিন, মনটা একটু ভারী লাগছিল, ‘তাই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে গুলি খেললাম। ওরা আমার সব গুলি জিতে নিল, কিন্তু আমার মন ভাল হয়ে গেল।’

কখন কেন যে তাঁর মন ভাল হয়ে যায়, রাসকিন বন্ড নিজেও জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। ওটাই তাঁর স্বভাব। বরফ-পড়া নির্জন পাকদণ্ডীতে হেঁটে যেতে যেতে কানে আসে অনেক দূরের রেডিয়োর গান, রাস্তার ধারে অনেক দিন ফেলে-রাখা ভাঙা গাড়ির গায়ে দিব্যি বেড়ে ওঠে গোলাপের ঝোপ, বর্ষার রাতে টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে, পড়েই চলে, তাঁর ভাল লাগে। কতক্ষণ থাকে সেই ভাল লাগা? যতক্ষণ, ততক্ষণ। মুসুরিতে মধুচন্দ্রিমায় আসা তরুণ দম্পতিরা ঘুরে বেড়ায়, জীবনপাত্র উছলে পড়ে তাদের সুখী ভালবাসা। ‘ওরা সবাই চিরকাল পরস্পরকে ভালবাসবে না, কিন্তু এখন তো প্রেম আছে, আর তাই ওরা এখন খুব সুন্দর, নির্ভয়।’ ইদানীং অনেকেই আবার নিজেদের আনন্দের খবর অন্যদেরও জানাতে তত্‌পর। ‘ধনী এবং বিখ্যাত মানুষরা আমাদের হিল স্টেশনে বাড়ি কিনেছেন, তাঁরা মাঝে মাঝে বন্ধুবান্ধব ডেকে হইহুল্লোড় করেন, সেই হাসি-গল্পের ধ্বনি শীতল নীরব রাত্রি বেয়ে ভেসে আসে।’ বিরক্তি হয়? না, ‘ওঁদের পার্টি আমার মতো লোকের জন্য নয়, কিন্তু আশেপাশে হাসিখুশি মানুষ আছে ভেবে আমার ভাল লাগে।’ অন্যকে খুশি দেখে খুশি হওয়ার ক্ষমতা যার নেই, সে হয়তো বলবে, ‘ও-রকমটা আবার হয় না কি?’ রাসকিন বন্ডের লেখা পড়তে পড়তে ভাবি, যার হয়, সে কিন্তু বেশ আছে।

এমন নিরিবিলি জায়গায় একা লাগে না? মনটা হাঁপিয়ে ওঠে না? একাকিত্বের কথা বার বার ফিরে আসে লেখাগুলিতে। শীতের রাতে পথের ধারে শুয়ে কাঁপতে থাকা অনাথ বালককে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরেন, রাস্তায় দেখা হয় কয়েকটা শেয়ালের সঙ্গে, অন্ধকারে তাদের সবুজ চোখ জ্বলতে থাকে, ‘কোনও দিন কোনও পশু আমার ক্ষতি করেনি, তবু মনে হয়, একটা সঙ্গী আছে, ভাল।’ পথ ভুলে অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়া বাদুড় ঝুলে থাকে খাটের পায়াটি ধরে, মনে হয়, ‘একলা রাতে উদ্‌ভ্রান্ত বাদুড়ও সঙ্গী বইকী।’ কখনও বা হেনরি ডেভিড থরো-র কথা মনে পড়ে তাঁর: ‘একা লাগবে কেন? আমাদের গ্রহটা কি ছায়াপথের মধ্যে নয়?’ বেশ বোঝা যায়, একাকিত্ব এই মানুষটার নিত্যসঙ্গী, তার বেদনাও অমোঘ, কিন্তু তাকে ছাড়া তাঁর চলবে না, কারণ ‘নিজের সঙ্গে থাকার জন্যে মাঝে মাঝে একলা হয়ে যেতে হয়।’ এমনকী, নিজের সঙ্গে থাকব বলে কাজ থেকেও মাঝে মাঝেই সরিয়ে নিতে হয় নিজেকে। সন্ধে নামছে, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, ‘জানলার ধারে বসে আছি, সামনে গাছের সারি, মেপ্‌ল গাছের পাতায় হাওয়ার ফিসফিস শুনছি, ... আকাশে যেটুকু আলো আছে তাতে বাদুড়টাকে দেখতে পাচ্ছি, আর গাছগুলোর একটা আদলও চোখে পড়ছে। নীচে রাস্তা দিয়ে কেউ একটা পুরনো গানের সুর শিস দিতে দিতে হেঁটে যাচ্ছে। একটা কাজ করার ছিল, কিন্তু মনে হয় এখানে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকব।’

রোমান পণ্ডিত এবং রাজপুরুষ সেনেকা বলেছিলেন, ‘আমি জীবনকে উপভোগ করি, কারণ আমি তা ছেড়ে যেতে প্রস্তুত।’ রাসকিন বন্ডকে বলতে ইচ্ছে হয়: আপনি আরও অনেক দিন থাকুন, ওই মেঘ-পাহাড়ের ওপরে, আপনার নিজের জায়গায়, নিজের মতো করে। আপনি থাকলে একটু ভরসা পাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE