Advertisement
E-Paper

‘তা হলে বোরখা পরেই লেখাপড়া শিখব’

পিতৃতন্ত্রের কঠোর সমালোচক, কিন্তু ইসমত চুঘতাই কোথাও সরল দাগের আগ্রাসনকারী পুরুষ ও অত্যাচারিত নারীর ছক বসান না। এই অগস্টে পূর্ণ হল তাঁর জন্মের একশো বছর।ফুড কর্পোরেশনের দালানের সামনে রোদজ্বলা দিনে গেলেই দেখতে পাবেন একটা কানাচ ঘেঁষে রাস্তার ওপর রুটি শুকোচ্ছে। রুটিগুলি মড়মড়ে, আকার নষ্ট, রিসাইক্‌ল্‌ড বলেও মনে হতে পারে। এ দৃশ্য দেখে একটা বাক্যবন্ধ বেজে উঠেছিল মাথায়। নানহীর নানি।

ঈপ্সিতা হালদার

শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩

ফুড কর্পোরেশনের দালানের সামনে রোদজ্বলা দিনে গেলেই দেখতে পাবেন একটা কানাচ ঘেঁষে রাস্তার ওপর রুটি শুকোচ্ছে। রুটিগুলি মড়মড়ে, আকার নষ্ট, রিসাইক্‌ল্‌ড বলেও মনে হতে পারে। এ দৃশ্য দেখে একটা বাক্যবন্ধ বেজে উঠেছিল মাথায়। নানহীর নানি।
এখন কী হয় জানি না, আমরা যখন তুলনামূলক সাহিত্য পড়তাম, ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় পড়ুয়াদের হস্তগোচর হত একখানা সিরিজ, অনুবাদে আধুনিক ভারতীয় ছোটগল্প। নানা ভারতীয় ভাষার বাঘা ছোট গল্পকারের লেখার বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা করেছিলেন আমাদেরই অধ্যাপক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘নানহীর নানি’ গল্পটি ওখানেই পাওয়া। ইসমত চুঘতাইয়ের নামও। পাঠ্যও ছিল ‘নানহীর নানি’। মানববাবুর টীকা-টিপ্পনী-সহ পড়ানোও ছিল তাঁর করা ওই অনুবাদের কাছাকাছি। সংকেতময়, ঝরঝরে ও শ্লেষাত্মক। এক ভিখমাগনি বুড়ি, নানহী বলে কোনও একটা নাতনি ছিল তার, এখন আর এই সব পারিবারিক বন্ধন নেই। সেই নানহীর নানি ছিল মহা বুদ্ধিমান, সদাসর্বদা দুর্দিনের জন্য প্রস্তুত। তাই, সে যা খাবার জোগাড় করত, একটা অংশ জমিয়ে রাখত। জল ঢেলে লেই করে রুটির আকারে গড়ে শুকিয়ে নিত। ব্যস, এ বার যদি টানা হপ্তা ধরে বাদলায় সে বেরোত না-ও পারে, তার খানা তোফা প্রস্তুত তারই ঝোলায়।
চুঘতাই উর্দু সাহিত্যিকদের অন্যতম অগ্রগণ্য। উনিশশো তিরিশ-চল্লিশের দশক থেকে ফেনিল আবেগসর্বস্বতা ঝেড়ে ঘোর বাস্তব নিয়ে লেখার সূচনা হয় উর্দুতে। বিশেষত ‘অঙ্গারে’ নামে একটা ছোটগল্পের বই ছাপা হওয়ায় ধর্ম-সামাজিক-ঐতিহ্য-শালীনতা-প্রেম— এ সব কিছুর ভিত্তিতে নাড়া পড়ে যাওয়ায় বের হয় ফতোয়া, বাজারে সেই বইয়ের কোনও নিশানাই আর থাকে না তার পর। ‘অঙ্গারে’র লেখকরা— সাজ্জাদ জাহির, রশিদ জাহান, আহমেদ আলি, মাহমুদুজ্জাফার— প্রগতিশীল লেখক সংঘ তৈরির সঙ্গে যুক্ত থাকবেন, আরও থাকবেন সাদাত হাসান মান্তো, কৃষণ চন্দর, রাজিন্দর সিংহ বেদি, যাঁদের হাতে তৈরি হবে, রক্ষিত থাকবে দেশভাগবিক্ষত ভীত ক্লিন্ন এই উপমহাদেশের ইতিহাস। এঁদেরই কমরেড চুঘতাই।
কিন্তু চুঘতাই আরও একটু কিছু। সাহসিক, আকাঁড়া বাস্তব রচনায় এলেমদার তিনি, অথচ মেয়েমহলে চোখ-ঠারা চোরাকাহনের অন্তরঙ্গতা তাঁর গল্পের উৎস। উর্দু সাহিত্যের নারীবাদী রশিদ জাহান তাঁর পূর্বসূরি, কিন্তু চুঘতাই আর একটু জটিল, এলোমেলো করে দেবেন সদ্য তৈরি হওয়া নারীবাদী প্রেক্ষিতকে, নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক আর ঘনিষ্ঠতাকে পড়তে গিয়ে। সম্পর্ক-প্রেম-কামনা কিছুই তখন না পড়া যাবে চেনা নারীবাদী ছকে, না পড়া যাবে প্রগতিশীল বামপন্থী শ্রেণি সম্পর্কের ছকে। নানহীর নানি এক সর্বহারা, কিন্তু তার সম্পূর্ণ বেপরোয়া একাকিত্ব আর দিনদুনিয়ার সব কিছু থেকে বিযুক্ত হয়ে থাকা কি সমাজের বাইরের কোন একটা জায়গাকে নির্দেশ করে না, যা শ্রেণিসম্পর্কেরও বাইরে?

আর লাজোকে নিয়ে তাঁর গল্প? যাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে কেউ, আর প্রায় দিন উপোস থেকে যে বয়সকালে শরীরকে চিনেছে মূলধন হিসেবে। মির্জার বাড়িটা তার ভাল লাগে বলে সে থাকে, আর থাকলে মির্জার তো তার শরীরটা ব্যবহার করারই কথা। না করলে লাজো তাজ্জব, বাঈজির প্রতি হিংসায় জ্বলে যে, আমি থাকতে মালিককে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে বাইরে! অন্য দিকে, মির্জার অধিকারবোধ এতখানি বেড়ে যায় লাজোর প্রতি যে, সে লাজোকে নিকাহ্ করে বসে। লাজো, যে কিনা ঘাগরাটা নেংটি করে পরে ঘরের কাজ করতে অভ্যস্ত, তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল কিম্ভূত এক বোরখা এবং আশা করা হল নিকাহ্ করা বউয়ের সতীত্ব। নিকাহ্ করেছে বলে মির্জা বউয়ের চৌকাঠ মাড়ায় না, পাছে ইয়াররা তাকে ভেড়ুয়া ভাবে। আর লাজো তো লাজো, অবরোধেও প্রেম বিলোয়। ফলে তালাক। এ বার সম্পর্ক সমানে সমানে ফের, নারী ও পুরুষের মধ্যে, নিকাহ বহির্ভূত।

আশ্চর্যের কথা এই যে, লাজোর মধ্যে দিয়ে চুঘতাই বিবাহ ও জন্মের বৈধতাকে খোলামকুচির মতো ছুড়ে দেন, তাকে তামাদি করে ফেলেন। লাজোকে যৌন ভাবে দেখা আর ব্যবহার করা-ই যদি হয় তার সমাজের মরদদের তরিকা, তা হলে তাকে উলটে উসকানি দেওয়া, মশকরার ছলে ব্যবহার করা বা তাতে কোনও ভাবে নিজেকে ভিকটিম না মনে করার কৌশল এই গল্পে রয়েছে। যেখানে তৈরি হয়েছে নারীর বশ্য যৌনতার ভাষ্যের বিপরীত ছবি। প্রগতিশীল লেখক সংঘের যুক্তিকে ক্রমাগত নাজেহাল করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন তখন চুঘতাই।

অন্য দিকে চুঘতাইয়ের অনন্য মুনশিয়ানা এই যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ দেখতে গিয়ে তিনি সরল দাগের আগ্রাসনকারী পুরুষ ও অত্যাচারিত নারীর ছক বসান না কোথাও। তাঁর নকশা অন্য ভাবে বোনা, অনেক বক্র তাঁর ভঙ্গি, অনেক স্তর ভাঁজ তাতে। চুঘতাই কখনও ক্ষমা করে দেন, কখনও তৈরি করেন মশকরার ছল। তাঁর একটু লীলা আছে, আছে তীব্র নিষ্ঠুরতা, শোকও। ‘দিল কি দুনিয়া’ নভেলাতে কুদসিয়া বানো কচি বয়সেই স্বামী-পরিত্যক্তা, ফিট খেত ভক্তির সুর মিশ্রিত হামদ শুনলে, এত ইন্দ্রিয়জ কামনাতুর ছিল সেই সদ্যোযৌবনের হতাশার বোধ। শেষে তার একটু গর্ববোধও হতে থাকে যে, এক মেমের জন্য তার স্বামী তাকে ছেড়েছেন। অর্থাৎ, দেশের রাজার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে কিছু। পাড়ার লোকেও সশ্রদ্ধ ভাবে তাকায়। নারীবাদের তীব্র প্রতিবাদের স্বর এখানে অনেক মনস্তাত্ত্বিক, অন্তর্ঘাতমূলক, পাঠানি বুয়া তার বাবা-মা-স্বামীকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে চাঁপা গাছের ডালে বেপর্দা বসে থাকে, তাকে প্রলুব্ধ করে লোকগানের যে নাগর মেরঠে চলে গেছে, তার কথা গেয়ে বিলাপ করে সে। নিজেকে মনে করতে থাকে ওই গ্রামের যে পীর বালে মিয়াঁ, যার মৃত্যুদিনে ওরস হয়, তাঁরই রাধা, মত্ত, দিওয়ানি। এ ভাবে তার ভিতরের কামনাগুলি, যা কোনও দিন পূর্ণতা পাবে না, জানলে লোকে বেহুদা বেশরম বলে দোর বন্ধ করে রাখবে, তা বলতে পারা যায় জোরে জোরে। অন্য বৈধতায়। শরিয়তি ধর্মের দিক থেকে দেখলে শাস্ত্রে তার ঠাঁই নেই, কিন্তু এই উপমহাদেশের লোকজ মরমিয়া তত্ত্বের ইতিহাসে সম্পূর্ণ সিদ্ধ। এক দিকে উত্তরপ্রদেশের উর্দু আফসানা, তাকে এলিট অন্তঃপুরের নিজস্ব রূপে দেখান চুঘতাই, অন্য দিকে তাঁর লেখা যেন জানানার মধ্য থেকে দেখা, নানা-নানী-বড়ি- আব্বা-আম্মা-বাঈজী-ছোটি বুয়া-ভাবীজান-চাচা সন্ধেবেলা লণ্ঠন-হাতে আলি বকশ। যাদের দেখার জন্য তিনি বেছে নেন এক বালিকা কথককে। বালিকার চোখ থেকে দেখায় জানাচেনা জিনিসগুলি হয়ে দাঁড়ায় না-জানা, সংকেতময়, ভয়াবহ বা সারল্যে ভরা। ঝিয়ের মেয়ে গাইন্দাকে যে গর্ভবতী করেছে ভাইয়া, বা এটা যে লেপের নীচে বেগম জান আর তার পরিচারিকা রাব্বু— রোজ রাত্তিরে ভয় দেখানো পাগল হাতি না, বালিকা কথকদের এই সব ভয় আর অজানা দিয়েই তৈরি হয় একটা সমাজের অবসন্নতা, ক্ষয়িষ্ণুতার ছবি, তার সমালোচনাও। ‘লিহাফ’ গল্পে অশ্লীলতার দায়ে চুঘতাইকে ’৪২-এ লাহৌরে আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। তাঁর লেখার বিবিধতা বিচিত্রতা এই গল্পটির জন্য চিরতরে ঢাকা পড়ে যায়। চুঘতাই নিজে বলেন, ভাগ্য তাঁকে এই লিহাফ লাঠির প্রহারে লেখকজীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ করে দিয়েছে।

আসলে চুঘতাই-এর রাজনীতি ভিন্ন। তিনি এ দেশীয় মুসলমান সমাজে প্রথম বিএড ডিগ্রি-সহ মহিলা গ্র্যাজুয়েট। সেই শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে লড়তে হয়েছে প্রথাগত সমাজের সঙ্গে। চুঘতাই বলেছিলেন, বোরখা পরে যদি পড়াশোনার সুযোগ পাই, তা হলে বোরখা পরেই সেই সুযোগ নেব। এ-ও রাজনীতির অন্য একটা পাঠ। যেখানে প্রতিবাদ সমালোচনার জন্য প্রাণ যায়, প্রশাসন সুরক্ষা দেওয়ার বদলে গোঁড়াদের সংবেদনশীলতায় আঘাত না হানতে বলে, সেখানে চুঘতাই-এর কাছে আমরা অন্তর্ঘাতের এই কৌশলও কি শিখতে পারি না?

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক

Ismat Chughtai Ismat Chughtai memorabilia Ismat Chughtai birth centinary nanhir nani abp post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy