Advertisement
E-Paper

গতিই জীবন ‘মাঠের মেয়ে’ জসমিনার

ছোটবেলা থেকেই মাঠ অন্ত প্রাণ। সবরকমের খেলাধুলোতেই তার আগ্রহ। কিন্তু দিশা দেখানোর কেউ ছিল না জসমিনার সামনে। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলার শিক্ষকের সাহায্য পেলেও কোচের অভাব অনুভব করে প্রতিনিয়ত। তাই সাইক্লিস্ট হওয়ার লক্ষ্য স্থির থাকলেও শটপাট থেকে জ্যাভলিন থ্রো – সবেতেই অংশ নেয় জসমিনা। আর তাতেই তার নাম হয়েছে মাঠের মেয়ে। লিখলেন অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়।ভেলিয়ানের মতো প্রান্তিক গ্রাম থেকে জসমিনার মতো গরীব পরিবারের মেয়ের সাইক্লিস্ট হওয়া তো দূর অস্ত খেলাধুলোর কথা ভাবাটাই বাস্তবে কঠিন। 

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:১৩
সাইকেলে জসমিনা খাতুন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

সাইকেলে জসমিনা খাতুন। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম

ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। উস্কুখুস্কু চুল, গায়ে ভিজে সপসপ করছে জামা-প্যান্ট। সরু চাকার গিয়ার দেওয়া সাইকেলের প্যাডেলে পায়ের চাপে চাকা ঘুরছে বনবন করে। মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এক কিশোরী। তার লক্ষ্য স্থির। গতিই জীবন তার। লোহাপুর আর নলহাটির রাস্তায় বাইরে থেকে আসা গাড়ির সওয়ারিরা অনেক সময় মোবাইলে ফ্রেমবন্দি করেন এই ছবি।

বীরভূমের নলহাটি থানার ভেলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা এই কিশোরীর নাম জসমিনা খাতুন। এলাকায় মাঠের মেয়ে নামে পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই মাঠ অন্ত প্রাণ। সবরকমের খেলাধুলোতেই তার আগ্রহ। কিন্তু দিশা দেখানোর কেউ ছিল না জসমিনার সামনে। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর খেলার শিক্ষকের সাহায্য পেলেও কোচের অভাব অনুভব করে প্রতিনিয়ত। তাই সাইক্লিস্ট হওয়ার লক্ষ্য স্থির থাকলেও শটপুট থেকে জ্যাভলিন থ্রো – সবেতেই অংশ নেয় জসমিনা। আর তাতেই তার নাম হয়েছে মাঠের মেয়ে।

ভেলিয়ানের মতো প্রান্তিক গ্রাম থেকে জসমিনার মতো গরীব পরিবারের মেয়ের সাইক্লিস্ট হওয়া তো দূর অস্ত খেলাধুলোর কথা ভাবাটাই বাস্তবে কঠিন। পাঁচ শতক জায়গায় উপরে পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটা ঘর। সেই ভাগের ঘরের একটায় কোনও রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই ভ্যান চালক সিরাজুল ইসলামের। সিরাজুল জসমিনার বাবা। বাবার কষ্ট লাঘব করতে খেলায় নাম করতে চায় কিশোরী মেয়েটি।

জসমিনারা তিন বোন। দুই বোনের লেখাপড়ার টাকাও সে জোগাড় করতে চায়। কিন্তু টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরের এক চিলতে বারান্দা থেকে নামতেই কাদায় মাখামাখি হয়ে যায় পা। ওই কাদা মাড়িয়েই গ্রামের মাদ্রাসায় প্রথম লেখাপড়া শিখতে যাওয়া। যাওয়া আসার পথে সবুজ মাঠ, পাড়ার ছেলেদের খো-খো, কবাডি বা ফুটবল খেলা নজর কাড়ত জসমিনার।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

মাদ্রাসায় খেলাধুলোর সুযোগ ছিল না। কিন্তু গ্রামের মাদ্রাসা থেকে স্থানীয় কয়থা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে জসমিনার খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে তাঁকে মাঠে নামাতে উদ্যোগী হন স্কুলের খেলার শিক্ষক স্বপন লেট। স্বপনবাবুর কাছেই শুরু হয় প্রথাগত প্রশিক্ষণ। শটপাট, জ্যাভলিন থ্রো, ডিসকাস থ্রো-তে এক এক করে নাম দেওয়া শুরু হয় জসমিনার। স্কুলের মাঠ থেকে ব্লক, মহকুমা এবং জেলাস্তরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে রাজ্য স্তরে প্রতিনিধিত্ব করে। সল্টলেক স্টেডিয়ামে বেশ কয়েকটি ইভেন্টের মধ্যে সাইক্লিং দেখে মনে মনে সাইকেলের প্রতি তীব্র আকর্ষণ তৈরি হয় জসমিনার।

সেবার ফিরে এসে খেলার শিক্ষককে সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা বলেছিল জসমিনা। স্থানীয় ক্লাব থেকে এলাকার ক্রীড়াপ্রেমী মানুষজনও খেলা পাগল জসমিনার সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা জানান বিদায়ী সাংসদ শতাব্দী রায়কে। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি জসমিনার বাড়িতে গিয়ে ১০ হাজার টাকা দেন শতাব্দী। সেই টাকায় একটি পুরনো সাইকেল কিনে অনুশীলন শুরু করে জসমিনা। নিজেই জানায়, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কর্দমাক্ত রাস্তায় পুরনো সাইকেলটা কাঁধে নিয়ে রানিগঞ্জ মোড়গ্রাম রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে সাইকেল নিয়ে অনুশীলন শুরু করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। প্রথমে ৫ – ৭ কিলোমিটার দূরের নলহাটি এবং লোহাপুর পর্যন্ত গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালানো, এরপর ধীরে ধীরে রামপুরহাট, নাকপুর চেকপোষ্ট পেরিয়ে মল্লারপুর, সিউড়ি মোড়গ্রাম বহরমপুর পর্যন্ত সাইকেল নিয়ে অনুশীলন।

স্থানীয়েরা বলেন, ‘‘প্যাডেলে পায়ের চাপ পড়ার পরেই দুদ্দাড়িয়ে ছুটতে থাকে জসমিনার সাইকেল। মেঠো পথ, খাল, বিল ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় ওঠার পরে দুরন্ত গতিতে গাড়ি-ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে জসমিনা।’’

কিন্তু টানা অনুশীলনে পর্যাপ্ত খাবার বা পানীয় থাকে না তার। অন্তত পাঁচ ঘন্টার অনুশীলনে সঙ্গে কেবল এক বোতল জল। বছর তিনেক ধরে এই রুটিনেই অভ্যস্ত সে। হু হু করে পথ চলা। ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফেরা। তারপরে খাবার বলতে প্রথম দিকে ছিল দু মুঠো ভাত, সঙ্গে থাকে কোনও দিন আলু সেদ্ধ। কোনও দিন শুকনো তরকারি। অভাবের সংসারে এর বেশি মেয়ের জন্য জোটাতে পারেন না ভ্যানচালক বাবা। প্রাথমিক পর্বে কেরালায় অনুষ্ঠিত সাইক্লিং-এর ন্যাশন্যাল চ্যম্পিয়নশিপে ২০ কিলোমিটারের প্রতিযোগিতায় পদক না জিতলেও নিজের জায়গা করে নেয় জসমিনা।

পরবর্তীতে ওয়েষ্ট বেঙ্গল সাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ৩৬ তম রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় দুটি ইভেন্টে প্রথম হয় সে। পরে আলিপুরদুয়ারে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হয়। ২০১৮ সালে ন্যাশনাল চ্যম্পিয়নশিপে ডাক পেলেও কিছু ভুল বোঝাবুঝির জেরে যোগ দেওয়া হয়নি। তবুও নিজের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যেতে চায় সে। তবে সাইক্লিং-এ ভাল সাইকেলের অভাব, ট্র্যাক না থাকার অসুবিধা বোধ করে জসমিনা। এবড়ো খেবড়ো পথে অনুশীলন করতে গিয়ে মাঝেমাঝেই সাইকেলের চাকা লিক হওয়া থেকে বিভিন্ন সমস্যায় যন্ত্রাংশ বদল করতে গিয়ে প্রচুর খরচ হয়।

কয়থা হাইস্কুলের এক শিক্ষিকা জসমিনাকে এগিয়ে যেতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। প্রতিদিন তার জন্য ছোলা, বাদাম, কাঠবাদাম-এর মতো পুষ্টিকর খাবারের জোগান দেন। তবে সাইক্লিং রেস এর জন্য জসমিনার দরকার ভাল রেসিং সাইকেল। দরকার উন্নত অনুশীলনের। সেই সুযোগ বীরভূমের এই প্রান্তিক গ্রামে নেই।

তাই মাঠের মেয়ে এখনও সাইকেলের সঙ্গে জ্যাভলিন-থ্রো, শটপুট, ডিসকাস-থ্রো এবং বক্সিং-এর অনুশীলন করে চলেছেন সমান তালে। সম্প্রতি ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বক্সিং অ্যাকাডেমির উদ্যোগে মেদিনীপুর-এর সালুয়াতে অনুষ্ঠিত ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট এলিট উওমেন বক্সিং চ্যম্পিয়নশিপে রৌপ্য পদক পায় জেসমিন।

সাইকেলে ইতিমধ্যে জাতীয় স্তরে প্রতিনিধিত্ব করে সার্টিফিকেট মিলেছে। লক্ষ্য আন্তর্জাতিক স্তর। সেই জন্য চাই একটু নজরদারি আর সকলের সহৃদয়তা এবং সহমর্মিতা। তবেই নিজের অভিষ্ট লক্ষ্য পূরণে পৌঁছতে পারবে সে এমনটাই দাবি নলহাটির প্রত্যন্ত গ্রাম ভেলিয়ানের জসমিনা খাতুনের।

Jashmina Khatun জসমিনা খাতুন Cyclist Boxing
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy