Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মোবাইলের যেখানে শেষ, এসএলআর-এর জাদু শুরু

সহজে চটজলদি হাতের নাগালে আসা এ কালের ফটোগ্রাফির জন্য কি ‘ফটোগ্রাফি’ শব্দটা ধীরে ধীরে সস্তা হয়ে যাচ্ছে? বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবসে লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্য মানব জীবনের হেঁশেল থেকে শোওয়ার ঘর সর্বত্র এখন ফটোগ্রাফির অবাধ বিচরণ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে ফটোগ্রাফি। মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপের মেসেজে প্রশ্নের উত্তরে, লেখার জায়গায় আসছে ছবি।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৯ ০৩:০৭
Share: Save:

আজ ক্লাস টু-র ছোট্ট মেয়েটাও জানে সেলফির মানে। মোবাইলকে কোন পজিশনে ধরে কী ভাবে দাঁড়িয়ে কোন অপশনে ক্লিক করলে, তার ছবি ভাল হতে পারে সে সবও অজানা নয় তার।

মানব জীবনের হেঁশেল থেকে শোওয়ার ঘর সর্বত্র এখন ফটোগ্রাফির অবাধ বিচরণ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে অজান্তেই জড়িয়ে যাচ্ছে ফটোগ্রাফি। মেসেঞ্জার, হোয়াটসআপের মেসেজে প্রশ্নের উত্তরে, লেখার জায়গায় আসছে ছবি। ছবি দেখে প্রশ্নকর্তা বুঝে নিচ্ছেন উত্তরদাতা কোথায় আছেন? কী করছেন? কী পড়েছেন আজ? সবার হাতে উন্নত ক্যামেরা দেওয়া মোবাইলই মনে হয় এই ফটোগ্রাফি নির্ভর জীবনযাত্রার একটা প্রধান কারণ। আর একটা বড় কারণ মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়া। ছবি তুলেই সঙ্গে সঙ্গে আপলোড। তৎক্ষণাৎ বহু মানুষের মতামত, লাইক, কমেন্ট পাওয়ার নেশাও আজ আট থেকে আশি সব মানুষকে করে তুলছে ফটোগ্রাফার। একটা সময়ে যে ফটোগ্রাফির শখ ছিল বড়লোকের বিলাসিতা, আজ তা সকলের অভ্যেস। শিল্পীর কাছে তাঁর সৃষ্টি সন্তানতুল্য। অনেক প্রবীণ ফটোগ্রাফারই মনে করেন, সেই সন্তান জন্মের আনন্দ ছিল ফ্লিম ক্যামেরায়। যত ক্ষণ না নেগেটিভ ডেভলপ হচ্ছে, তত ক্ষণ কৌতূহল, কী তুললাম? আর কী দাঁড়াল সেটা জানার। একটা ফ্লিমে ৩৫টা ছবি হত। তাই সাধারণ ঘরের শখের ফটোগ্রাফারদের অত্যন্ত বুঝে মেপে ছবি তুলতে হত খরচ বাঁচানোর জন্য। এই কষ্টের ফটোগ্রাফি সাধনাই হয়তো আরও গভীর ভাবে ফটোগ্রাফিকে ভালবাসতে শেখাত তখন। যেখানে কষ্ট আছে সেখানেই তো প্রাপ্তির আনন্দ। ভালবাসতে গেলে তো প্রথমে তাকে ভাল করে জানতে হবে, বুঝতে হবে।

আর আজ ডিজিটাল যুগে একেবারেই তোলা যাচ্ছে হাজার হাজার ছবি। সঙ্গে সঙ্গে দেখে নেওয়া যায় কী উঠল। পছন্দ না হলে মুছে দিয়ে নতুন ছবি। ক্যামেরা বা মোবাইল কেনার প্রাথমিক খরচ বাদে ছবি তোলার খরচ প্রায় নেই বললেই চলে। ডিজিটাল ক্যামেরার হাত ধরে আজ ফটোগ্রাফি অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। মোবাইলে ক্যামেরা আসার পর তা এখন সবার নাগালের মধ্যে। আগের মতো সেই নেগেটিভ ডেভলপ না হওয়া পর্যন্ত দেখতে না পাওয়ায় কৌতূহল, উত্তেজনা আর অপেক্ষা— সবটাই হারিয়ে গিয়েছে ডিজিটাল যুগে। ডার্ক রুম আজ কম্পিউটারের সিপিইউ-এ বন্দি। প্রেস ফটোগ্রাফি থেকে পিকটোরিয়াল সবেতেই থাবা বসাচ্ছে মোবাইল। কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে সেই জায়গা ঘিরে ফেলছে মোবাইল ক্যামেরা। তেমনই আবার সুন্দর কিছু চোখে পড়লে ধরে রাখার চেষ্টাও সেই মোবাইলেই। তাই প্রশ্নটা এখানেই— সহজে চটজলদি হাতের নাগালে আসা এ কালের ফটোগ্রাফির জন্য কি ‘ফটোগ্রাফি’ শব্দটা ধীরে ধীরে সস্তা হয়ে যাচ্ছে? না কি তার সম্মান বাড়ছে দিনে দিনে?

দুই-ই আংশিক সত্যি। যদি সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে ধরা হয় তবে বলতে হয় সংবাদের ক্ষেত্রে নান্দনিক দিকের চেয়েও ডকুমেন্ট বা প্রামাণ্য চিত্রটাই গুরুত্বপূর্ণ সবার আগে। তাই সাধারণ মানুষের মোবাইলে ছবি তুলে রাখার প্রবণতার জন্য যেমন প্রমাণ লোপাট হওয়ার আশঙ্কা কমছে, খবরটার সত্যতা বাড়ছে, তেমনই আবার উল্টো দিকের খারাপ দিক হল, মানুষ এখন অতি উৎসাহী হয়ে বিভিন্ন ঘটনা বা কারও ব্যক্তিগত মুহূর্তের এমন ছবি বা ভিডিয়ো তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দিচ্ছেন, যা সমাজ বা সেই ব্যক্তির পক্ষে ক্ষতিকর। মানুষের ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকছে না। এর মূল কারণ হল যা তুলছেন, সেই বিষয়টা সম্বন্ধে ধারণা না থাকা। আর বেলাগাম, ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তোলার ক্ষেত্রে নানা আইন থাকলেও সেই আইনের ঠিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা। কোন ছবি, কোথাকার ছবি তোলা যায় আর কোন ছবি তোলা যায় না, সে সব না জেনে না মেনেই সাধারণ মানুষের এই ছবি তোলার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। অন্য দিকে নান্দনিক বা সাধারণ পথঘাটের জীবনযাত্রার ছবির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে এক সঙ্গে এক গুচ্ছ ক্যামেরা বা মোবাইল একটা বিষয়ের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ায় বিষয়বস্তুর স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। মোবাইলে যা তোলা সম্ভব নয় সে ছবিও তুলতে মোবাইল নিয়ে বিষয়বস্তুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন অনেকে। তাই ছবি প্রাণ হারাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই।

তবে এই ভিড়ের মধ্যেও কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের সত্যি খিদে আছে জানার, শেখার। তাঁরা লাভবান হচ্ছেন ফটোগ্রাফি সহজ আর সস্তা হয়ে আসায়। প্রচুর ছবি প্রায় বিনামূল্যে তুলতে পারায় তাঁরা সহজেই ছবি তোলা শেখার কাজটা করতে পারছেন। এই ডিজিটাল যুগে প্রতিনিয়ত সারা বিশ্বে অসংখ্য ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা হচ্ছে, যেখানে কম্পিউটারে বসে এক ক্লিকেই অংশগ্রহণ করা যায়। সেখানেও অংশ নিতে পারছেন তাঁরা খুব সহজেই। তবে ফটোগ্রাফিতে একটা সীমার পর এগোতে গেলে তা আর মোবাইলে সম্ভব নয়। মোবাইলের যেখানে শেষ, এসএলআর-ক্যামেরার জাদু শুরু সেখান থেকেই। আর এই জাদুর জাদুকরেদের দাম আগেও যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। বরং সংখ্যাটা দিন দিন বাড়েছে ডিজিটাল যুগে। উন্নত ক্যামেরা আর সহযোগী নানা উন্নত যন্ত্রাংশের ব্যবহার শিল্পীকে অনেক বেশি ভাল কাজ করতে সাহায্য করছে। যত বেশি জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে ফটোগ্রাফি, ততই বেশি দাম বাড়বে দক্ষতার।

প্রকৃত গুণী তাঁর দাম পাবেন ঠিকই। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি তাঁদের ছবি তোলার নিয়ম নীতি সম্বন্ধে এখনও সচেতন না হন, তা হলে আগামী দিনে অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্টের মতো অবস্থা হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE