Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রাঢ় বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতির ভাষ্যকার

আধুনিক যুগে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার একটি বিশেষ ধারা তাঁর রচনায় প্রকাশিত হয়েছে। লিখছেন অচিন্ত্যকুমার দত্তআধুনিক যুগে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে। বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার একটি বিশেষ ধারা তাঁর রচনায় প্রকাশিত হয়েছে। লিখছেন অচিন্ত্যকুমার দত্ত

রমাকান্ত চক্রবর্তী। ফাইল ছবি

রমাকান্ত চক্রবর্তী। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

রাঢ় বাংলার অন্যতম প্রধান জেলা বর্ধমান। একে ‘রাঢ় বাংলার মধ্যমণি’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলার ইতিহাসে বর্ধমানের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক সমৃদ্ধির কথা বারবার উল্লিখিত হয়েছে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখায় বর্ধমানের বৈচিত্র বর্ণিত হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রমাকান্ত চক্রবর্তী। তাঁকে বিদ্যাসাগর কলেজ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও এশিয়াটিক সোসাইটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সূত্রে পেয়েছিল। মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে। বাংলা সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনার একটি বিশেষ ধারা তাঁর রচনায় প্রকাশিত হয়েছে।

বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মের উপরে তাঁর গবেষণা বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে। শুধু পুথি, কাব্যগ্রন্থ ও অন্য নথিপত্রের উপরে নির্ভর করে তিনি ইতিহাস লেখেননি। বৈষ্ণব ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ শ্রীপাট ও আখড়া সমূহের ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে তিনি বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন। তাই বৈষ্ণব ধর্মের উপরে তাঁর গবেষণা অত্যন্ত সজীব ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠতে পেরেছিল।

বাংলায় বৈষ্ণবীয় গবেষণার পথিকৃৎ ছিলেন ভাষাচার্য সুকুমার সেন। তাঁর ‘শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’ দ্রষ্টব্য। তা ছাড়া তাঁর আত্মজীবনীতে (‘দিনের পর দিন যে গেল’, ২০০১) তিনি বর্ধমানের কয়েক জন বৈষ্ণব গুরু, তাঁদের আখড়া ও কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরেন (পৃষ্ঠা ৭৪-৭৬)।

গৌড়বঙ্গে প্রচলিত বৈষ্ণবধর্মের কেন্দ্রবিন্দু মানুষ। কিন্তু বৈষ্ণবীয় তত্ত্বে এই মানুষকেই এড়িয়ে যাওয়া হয়। সমাজ সংসারে এর গতিপ্রকৃতি ও তাৎপর্য নির্ণয় গৌণ হয়ে পড়ে। বিষয়টি রমাকান্তবাবুর গবেষণায় প্রাধান্য পেয়েছিল। বাংলায় বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন ছিল মূলত ধর্মীয়, তবে এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক তাঁর লেখায় পরিস্ফুট হয়েছে। সমাজে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে চৈতন্য পরবর্তী আন্দোলনের গভীর ও যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এর মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেলবন্ধনও ঘটেছিল। দুই সম্প্রদায়ের মানুষই রাধা-কৃষ্ণকে সমান ভাবে ভালবাসতেন।

রাঢ় বাংলার বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাস চর্চায় তিনি বর্ধমান জেলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এখানে ষোড়শ শতক থেকে আঠারো শতকের মধ্যে নির্মিত অসংখ্য বৈষ্ণব শ্রীপাট ও বৈষ্ণব মন্দিরের পরিচয় পাওয়া যায়। বর্ধমানের কুলীনগ্রাম, নবগ্রাম, শ্রীখণ্ড, কাটোয়া, কোগ্রাম, কালনা প্রভৃতি স্থানে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের বিশেষ প্রভাব ছিল।

বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশে বর্ধমানের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। কুলীনগ্রামের মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্য-সহ এই জেলার প্রসিদ্ধ চৈতন্যজীবনাকারদের (বৃন্দাবন দাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, লোচনদাস, জয়ানন্দ) রচনার আলোয় বর্ধমানে বৈষ্ণবধর্মের জনপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। উচ্চবর্ণভুক্ত ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। যেমন, বর্ধমানের রাজা তিলকচাঁদ, বাবাজি গোপালদাসকে ৬৯ বিঘা নিষ্কর জমি দিয়েছিলেন ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে। গোপালদাস কেতুগ্রামের কাছে দধিয়া বৈরাগ্যতলায় একটি শ্রীপাট স্থাপন করেন। সেখানে মন্দির নির্মাণ করা হয়। এবং রঘুনাথ জিউ প্রতিষ্ঠিত হন।

উচ্চবর্ণের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ জনও বৈষ্ণবধর্মকে আপন করে নিয়েছিলেন। পূর্ব বর্ধমানের বহু গ্রামে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব ধর্ম মিলেমিশে রয়েছে। সম্ভবত চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে গ্রামাঞ্চলে এমন ধর্মীয় সমন্বয় ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের রীতি প্রচলিত ছিল। বৃন্দাবনদাস অন্য ধর্মের প্রতি বৈষ্ণবদের শ্রদ্ধাশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এ ভাবে জীবনের সঙ্গে তত্ত্ব মিশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম বর্ধমানে এক প্রামাণ্য মতবাদ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। রমাকান্তবাবুর মতে, ‘প্রাচীনের সঙ্গে আধুনিকতার এক স্বসংবেদ্য মিশ্রণে বর্ধমানের সংস্কৃতি প্রাণবন্ত।’

সমাজ ও সংস্কৃতিকে ভাল ভাবে না জানলে রাজনৈতিক চেতনার জাগরণ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বোঝা শক্ত— এই ধারণাই পোষণ করতেন রমাকান্তবাবু। তাঁর ‘ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বার্ডোয়ান’ (১৯৮৫) নামক পুস্তিকা থেকে জানা যায় উনিশ শতকের সূচনায় বর্ধমান ছিল প্রাগাধুনিক বাংলা সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। আঠারো শতকে বর্ধমানের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রামে এক একটি করে নেটিভ স্কুল তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাদান করা হত। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িকতা সে ভাবে মাথাচাড়া দেয়নি।

কিন্তু বাংলার উনিশ শতকীয় নবজাগরণের ঢেউ সে ভাবে বর্ধমানে আসেনি। তারাচাঁদ চক্রবর্তী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক ও রামতনু লাহিড়ির মতো ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন সূত্রে বর্ধমানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও বর্ধমানের সামাজিক বিকাশে তাঁরা উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করেননি। রাজনৈতিক চেতনার জাগরণে এই জেলার অনগ্রসরতা অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকে এখানে আধুনিক শিক্ষার উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়নি। উচ্চবর্ণের স্বচ্ছল পরিবারের অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষালাভের জন্য কলকাতায় পাঠাতেন। ফলে বর্ধমানের শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সম্ভবত সেই কারণেই এখানে স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা হয় অনেক দেরিতে।

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি রমাকান্তবাবুর প্রেম ও এ বিষয়ে লব্ধ জ্ঞানই সম্ভবত তাঁকে নিধুবাবুর টপ্পার ইতিহাস লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ফলে বাংলার পাঠকসমাজের হাতে এল ‘বিস্মৃত দর্পণ: নিধুবাবু, বাবু বাংলা ও গীতরত্ন’ (১৯৭১)।

উনিশ শতকে বাংলার সঙ্গীত জগতের এক বিশিষ্ট নাম ছিলেন নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্ত। বাংলার বিভিন্ন গায়ক ও ওস্তাদের পাশাপাশি সমকালীন ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বর্ধমানের মহারাজা তেজচাঁদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। সে যুগে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত চর্চার মূল কেন্দ্রগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল বর্ধমান। এখানে কীর্তনের রূপে পুরনো বাংলা গান চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে বর্ধমান ও বীরভূমে ‘খেয়ালাঙ্গ’ মনোহরশাহি কীর্তনের উদ্ভব হয়েছিল। তাতে রাগ রাগিণির মিশ্রণ সুস্পষ্ট ছিল। শেষ পর্যন্ত এই গান ‘বৈঠকী’ হয়ে পড়ে। কালীদাস চট্টোপাধ্যায় অথবা কালী মির্জা ছিলেন বর্ধমান রাজ দরবারের এক খ্যাতি সম্পন্ন সঙ্গীতশিল্পী।

হিন্দি টপ্পা গানের সাহায্যে বাংলা ভাষায় নতুন ঢংয়ের গায়ক ও গীতিকার নিধুবাবু আখড়াই গানের (বৈঠকি গান) প্রবর্তন করেন। রাগ রাগিনী মিশ্রিত ধ্রুপদী সঙ্গীতের ধারা এর মধ্যে লক্ষণীয়। তাঁর গান উনিশ শতকে বাঙালি সমাজকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। যাত্রা ও থিয়েটারের গান, পাঁচালি গানের উপর এর প্রভাব পড়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। নিধুবাবুর গানের মূল্যায়ন করেন রমাকান্তবাবু। এ ভাবে বাংলার নবজাগরণ থেকে উদ্ভূত সামাজিক পরিবর্তনের আলোয় নিধুবাবুর ঐতিহাসিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়। রমাকান্তবাবুর রচনায় তথ্যনিষ্ঠ ও যুক্তিনির্ভর ইতিহাস আলোচনার ধারাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তত্ত্ব ও তথ্যের সমাহার, বর্ণনা এবং বিশ্লেষণের সমন্বয় ও যুক্তিপূর্ণ মূল্যায়ন লক্ষণীয়।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Culture Bengali Ramakanta Chakraborty
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE