Advertisement
১১ মে ২০২৪

নদিয়া নিবাসে সে দিন কত আখ্যান বুকে বইছিল জলঙ্গি

১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভেন-ডেক-ব্রুকের মানচিত্রে বড়-বড় করে লেখা ‘জলগাছি’ বলে যে নদীধারাটি দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল জলঙ্গির প্রবাহ। লিখছেন রাহুল হালদার১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভেন-ডেক-ব্রুকের মানচিত্রে বড়-বড় করে লেখা ‘জলগাছি’ বলে যে নদীধারাটি দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল জলঙ্গির প্রবাহ।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০২:৪৫
Share: Save:

কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে নদিয়া একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের মতোই নানা গুণে সমৃদ্ধ এই জনপদ। জেলাটির প্রাচীন ইতিহাস ভাগীরথীর স্রোতের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে। আর তাতে খানিক ভাগিদারি নিয়ে নিয়েছে এখানকার আর এক নদী জলঙ্গি। বর্তমানে জলঙ্গি নদী যার অতীতে নাম ছিলো খড়িয়া, সেটি মুর্শিদাবাদে প্রবাহিত পদ্মা থেকে উৎপন্ন হয়ে নদিয়ার পলাশিপাড়া, তেহট্ট, কৃষ্ণনগর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়ে মায়াপুরের কাছে ভাগীরথীতে পড়েছে। জলঙ্গি ও ভাগীরথীর মিলিত প্রবাহটি হুগলী নদী নামে পরিচিত হয়েছে।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী তাঁর "পল্লী কথা" প্রবন্ধে তৎকালীন করিমপুরের অবস্থান সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন "নদীয়া জেলা চারটি মহকুমায় বিভক্ত। মোটামুটি ধরিতে গেলে, দক্ষিণে রানাঘাট, পূর্বে কুষ্টিয়া, মধ্যে চুয়াডাঙ্গা এবং উত্তরে মেহেরপুর মহকুমা। পদ্মানদীর তীরে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জলঙ্গী নামে যে প্রাচীন গ্রাম, তাহারই নিকট পদ্মা হইতে খড়িয়া বা জলঙ্গী নদী বাহির হইয়া ধেঁড়িদহ, মোক্তাপুর, গোঘাটা, ত্রিহট্ট, গোয়াড়ী প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করিয়া নবদ্বীপের নিন্মে গঙ্গার সহিত সন্মিলিত হইয়াছে।"

(এই বর্ণনা যখনকার, তখন বঙ্গ অবিভক্ত। তদানীন্তন কুষ্টিয়ার পূর্ব ভাগ, চুয়াডাঙা ও মেহেরপুর বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত।)

সেই সময়ে স্থাননামের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে লেখক জলঙ্গির যে গতিপথের কথা বলেছেন, সেটা তো ষোলো আনা ঠিক। ষোলো আনা ঠিক হলে আমাদের মনে প্রশ্ন আসে, তবে কিসের জন্য এই আলোচনা। তার উত্তরে বলব, যেটা আমাদের আলোচ্য সেটা হল এই যে, বর্তমানের মায়াপুরের কাছে এসে জলঙ্গির যে ধারাটি ভাগীরথীতে মিশেছিল, সেই ভাগীরথীর থেকেই নদীর আর একটি শাখা নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুরের দিকে প্রবাহিত হয়েছিল। এখনকার সময়ে সেই শাখাটি প্রবাহিত না হলেও আমরা তার অস্তিত্ব খুঁজে পাই শান্তিপুর -ভালুকা হয়ে নবদ্বীপগামী রাস্তার পাশে বিভিন্ন খাল-বিল ও নানা নিচু জলাশয়ের অংশ থেকে।

কথাটি গালগল্প মনে হলেও সেই গালগল্প সত্য রূপে প্রকটিত হয় যখন আমাদের চোখের সামনে চলে আসে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে ভেন-ডেক-ব্রুকের মানচিত্র। সেই মানচিত্রে বড়-বড় করে লেখা ‘জলগাছি’ বলে যে নদীধারাটি দেখানো হয়েছে, সেটাই ছিল জলঙ্গির প্রবাহ।

জলঙ্গির উক্ত ধারাটি যে প্রবাহিত ছিল, সেটা প্রমাণ করার জন্য আগে আমাদের দেখে নিতে হবে তৎকালীন শান্তিপুরের ভৌগোলিক অবস্থান কেমন ছিল। অদ্বৈতাচার্যের সময়কালকে প্রামাণ্য হিসাবে ধরলে আমরা তৎকালীন শান্তিপুরের চারপাশের যে বর্ণনা পাই, সেটা নিম্নরূপ—

“শান্তিপুর গ্রাম হয় যোজন প্রমাণ।/ প্রভু কহে নিত্যধাম মথুরা সমান।।/ বৈকুণ্ঠে বিরজা নদী বহে চতুর্দিগে।/ শান্তিপুর দ্রবময়ী বহে তিন ভাগে।।’’

হরিচরণ দাস কৃত ‘অদ্বৈতমঙ্গল’-এর বর্ণনা থেকে আমরা দেখি, সেই সময়ে শান্তিপুরের উত্তরে, পূর্বে ও দক্ষিণে ভাগীরথী প্রবাহিত ছিল। উত্তর দিকের বাবলা যেখানে বর্তমানে অদ্বৈতপাট অবস্থিত সেখান থেকে পূর্ব দিকে ঘোড়ালিয়ার কাছে নির্ঝরের খাত এখনও দেখা যায়।দ ক্ষিণ দিকে আগের মতো এখনও গঙ্গা প্রবাহিত হচ্ছে।

১৭৮১ খ্রীষ্টাব্দে উলার দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখায় আমরা দেখি—

“পাটুলি দক্ষিণে করি, প্রমানন্দে সুরেশ্বরী,

নবদ্বীপ সমীপে আইলা।

গঙ্গাকে সারদা কন মম ভক্ত বিবরণ

আছে হেথা বলিয়া চলিলা

অম্বিকা পশ্চিমা পারে শান্তিপুর পূর্বধারে

রাখিল দক্ষিণে গুপ্তিপাড়া।

উল্লাসে উলার গতি বটমূলে ভগবতী

চণ্ডিকা নহেন যথা ছাড়া।“

অর্থাৎ তখনকার দিনে গঙ্গার একটি শাখা বাবলার দক্ষিণ দিকে কিছু দূরে গিয়ে দক্ষিণাভিমুখী হয়ে তারপর বানক ও নির্ঝরের মধ্যে দিয়ে সারাগড় হয়ে বক্তার ঘাটে মূল গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়। এই মূল গঙ্গাটি শান্তিপুরের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গুপ্তিপাড়া, কালনা হয়ে মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের দিকে চলে যেত। আর বাবলার দিকে অপর শাখাটি ভালুকা সগুনা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নদিয়ারাজের বাগানবাড়ি গঙ্গাবাস বা আনন্দবাসের দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত হতো। গঙ্গাবাস ভালুকার উত্তর দিয়ে প্রবাহিত বাগআঁচড়া পর্যন্ত শাখাটি ছিল জলঙ্গি নদীর একটি শাখা যা ভ্যান-ডে-ব্রুকের মানচিত্রে বড় করে জলগাছি (Galgatese) বলে উল্লিখিত, সেটিই এই নদীখাতের উৎকৃষ্ট প্রমাণ ।

এই শাখাটি বাগআঁচড়ায় এসে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একটি শাখা বাগদেবীতলা দিয়ে গঙ্গায় মিলিত হয়েছে। আর একটি শাখা পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে দিগনগরের পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে গোবিন্দপুর ডিঙিপোতা গ্রামের পাশ দিয়ে এসে দু’টি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। এর একটি শাখা পশ্চিম দিকে রঘুনাথপুরের রঘু মণ্ডলের দিঘিতে মিলিত হয়ে দক্ষিণ পূর্বমুখী শান্তিপুরের মেলের মাঠের মধ্যে দিয়ে এসে পালের দিঘি, সরের পুকুর, লঙ্কাপুকুর, রায়পুকুর, সাহাদের পুকুরের মধ্যে দিয়ে মূল গঙ্গায় পড়েছে। অন্য শাখাটি ডিঙিপোতা কুতুবপুরের পাশ দিয়ে পূর্বমুখী হয়ে শান্তিপুর রেল স্টেশনের উত্তর দিকের পুলের মধ্যে দিয়ে বাবলার দক্ষিণভাগ, বানক ও নির্ঝরের মধ্যে দিয়ে সাড়াগড় হয়ে মূল গঙ্গায় পড়েছিল, যে শাখাটি এক সময়ে উলা বৈঁচি হয়ে ফুলিয়া পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

আমরা প্রাচীন নবদ্বীপ-বর্ণনায় দেখি, নগরটির পশ্চিমে পূর্বস্থলী, জননগর, উত্তরে সিমুলিয়া, দক্ষিণে মহিশুরা ও সমুদ্রগড় এবং পূর্ব দিকে ছিল জলঙ্গি বা খড়িয়া নদী আর এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ছিল নবদ্বীপ নগর। শান্তিপুর, ফুলিয়া ছিল নবদ্বীপের পূর্ব দিকে। আদি বৈষ্ণব গ্রন্থ 'চৈতন্য ভাগবতে' জলঙ্গি বা খড়িয়ার নাম পাওয়া যায় না, কিন্তু নবদ্বীপ থেকে শান্তিপুর ফুলিয়ায় যে এখানকার মানুষদের যাতায়াত ছিল সেটি উক্ত গ্রন্থে লেখা রয়েছে। লেখাটিতে দেখি------ "এ সব আখ্যানে যত নবদ্বীপবাসী।/ শুনিলেন গৌড়চন্দ্র হইলা সন্ন্যাসী।।/ ফুলিয়া নগরে প্রভু আছেন শুনিয়া।/ দেখিতে চলিলা সব লোক হর্ষ হৈয়া।।/ অনন্ত অর্ব্বুদ লোক হৈল খেয়াঘাটে।।“ (চলবে)

(উদ্ধৃতির মধ্যে বানান অপরিবর্তিত)

শিক্ষক, শান্তিপুর হরিপুর উচ্চ বিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jalangi River History
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE