আঙ্গিক: পাইক নাচের শিল্পীরা। নিজস্ব চিত্র
দু’ভাগে ভাগ করা যায় ছো নাচ তথা ছৌ নাচকে। মহড়া নাচ ও পাইক নাচ। স্থানীয় ভাবে মহড়া শব্দের অর্থ হল মুখোশ। আগে মহড়া শব্দ মুহা নামে ব্যবহৃত হত। বর্ণময় মুখোশ পরা ছো নাচের বিকাশ ও বিস্তার পুরুলিয়ায়। আর মুখোশবিহীন ছো নৃত্যই পাইক নাচ। দু’টো নাচই রণনৃত্য। যার সঙ্গতে ঢোল-ধামসার গুরুগম্ভীর আওয়াজ রণবাদ্য। পাইক নৃত্যের বিশেষত্ব হল, নাচটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম সীমানা বাংলা তথা সংলগ্ন ওড়িশার এক গণবিদ্রোহের ইতিহাস। বিদ্রোহটি অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকের জঙ্গলমহলের পাইক বা লায়েক বিদ্রোহ।
ব্রতচারীর জনক এবং লোকনৃত্য বিশারদ গুরুসদয় দত্ত মনে করেন, প্রত্যেকটি লোকনৃত্যের পিছনে এক একটি অভিপ্রায় বা ‘মোটিভ’ যাকে। সেই সূত্রে পাইক নাচে ‘ওয়ার মোটিভ’ বা যুদ্ধ অভিপ্রায় রয়েছে। এটি আদতে ঢাল, তরোয়াল, লাঠি, তীর ধনুক প্রভৃতি লোক-আয়ুধ নিয়ে যৌথ রণনৃত্য। ঢোল, ধামসা ও সানাইয়ের তালে তালে শিল্পীরা পা ফেলেন। দ্রুত তালের এই নাচ আয়ত্ত করতে যথেষ্ট সাধনা প্রয়োজন। শ্রমনির্ভর এই নাচ দর্শকমনে প্রচণ্ড আলোড়ন তৈরি করে। বর্তমানে রায়বেঁশে নাচের মতো পাইক নাচের শিল্পীরা অস্ত্র হাতে শারীরিক কসরত দেখান। যদিও লোকনৃত্যটির গানে কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী কথা ও সুর। সেরকই একটি গান— ‘হায় বিধি এ কী হইল।/বিদেশিরা দেশে আইন।।/জমি জায়গা লিল কেড়ে/অন্নহারা বাঁচি কী করে’।
কী ভাবে জন্ম হয়েছিল পাইক নাচের? ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানি লাভের সময় (১৭৬৫) পর্যন্ত সামন্ত জমিদারদের ফরমান কার্যকরী করার মাধ্যমে ছিলেন পাইকরা। এঁরা এঁদের পরিষেবার বিনিময়ে নিষ্কর জমি ভোগ করতেন (পাইকান স্বত্ব)। তিন ধরনের পাইক ছিলেন। প্রথম হল পাহাড়ি। এঁদের হাতে ঢাল-তলোয়ার থাকত। দ্বিতীয় ধরনের পাইক হলেন বানুয়া। যাঁরা বন্দুক নিয়ে অভিযানে যেতেন। তৃতীয় ধরনের পাইকদের বলা হত, ঢেকিয়া যাঁদের সঙ্গী ছিল তির–ধনুক। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করে ইংরেজ শাসক ভেরে লাস্ট সেনানায়ক ফার্গুসনকে জঙ্গলমহলে জমিদারের নগদে আলা–সিক্কা মুদ্রায় কর আদায়ে বাধ্য করার নির্দেশ দিলেন। ফার্গুসন ছলে বলে কৌশলে লালগড়, রামগড়, ঝাড়গ্রাম, জামবনি, ধলভূম প্রভৃতি রাজা-জমিদারদের কর প্রদানে বাধ্য করেন। কিন্তু সেই সময়েই তলায় তলায় ব্রিটিশ বিরোধী অসন্তোষ জমা হতে শুরু করেছিল। আর তা ছড়াচ্ছিল জমিদার ও সংশ্লিষ্টে কর্মীদের মধ্যে। ১৭৬৬ থেকে পাইকদের জমি কেড়ে নেওয়ার কাজ শুরু হল। ওদিকে কর্ণগড়ের রানি শিরোমণি, শিলদার কিশোরমণি, ধলভূমের জগন্নাথ ধল, গড়বেতার অচল সিংহ, সিমলাপালের গোবর্ধন দিকপতি বিক্ষুব্ধ পাইকদের সংঘবদ্ধ করে জঙ্গলমহলে ব্রিটিশদের আঘাত হানার পরিকল্পনা করেন। যার ফলশ্রুতি ১৭৯৯ সালের চুয়াড় বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহে পাইক বা লায়েক বিদ্রোহীরা সামিল হয়েছিলেন।
যতদূর মনে হয়, পাইক বিদ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত রুক্ষমাটির ধলভূমগড় ছিল পাইক নাচের উৎসস্থল। সেখানকার ধবল রাজবংশ পরবর্তী কালে চিল্কিগড়ে রাজত্ব করতে শুরু করেন। ধলভূমের রাজা জগন্নাথ ধল শিলদার রানি কিশোরমণির কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি চিল্কিগড়ে থেকে চুয়াড় বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন। ইংরেজ সেনাপতি ফার্গুসনও জগন্নাথ ধলকে পরাজিত করতে একাধিক অভিযান চালান। উনিশ শতক এবং বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ধলভূম ও চিল্কিগড়ের ধবলদের রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় অস্ত্রসস্ত্র-সহ বীরধর্মী পাইক নাচের উদ্ভব ঘটে। পাইকনাচের সংস্কৃতি অঞ্চল ওড়িশা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল। এ বিষয়ে প্রখ্যাত ওড়িয়া সাহিত্যিক কালিন্দীচরণ পাণিগ্রাহী বলেন “পাইক নৃত্য ছউ নৃত্যেরই একটি অংশ। মহারাজ যদুনাথ ভঞ্জ মদিন সিং বাবু নামে ধলভূমের এক নৃত্য বিশারদকে দিয়ে এই নাচে বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন’। যেটা লক্ষ্য করার বিষয়, যে যে এলাকায় পাইক বিদ্রোহ ঘটেছিল সেই জায়গাগুলোই বর্তমানে পাইক নাচের বহুকেন্দ্রিক বিকাশস্থল। ঝাড়গ্রাম জেলার জামবনি ব্লকের (যার কেন্দ্র চিল্কিগড়) দুবড়া, বালিডিহা, কুড়ারিয়া, বেলপাহাড়ি ব্লকের কাঁটিশোল, বেলপাহাড়ি (যেখানে শিলদা), সাঁকরাইল ব্লকের ডাহি, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ধেরুয়া, গড়বেতার গনগনির মাঠের সংলগ্ন এলাকায় পাইক নাচের দল পাওয়া গিয়েছে। ময়ূরভঞ্জে এখনও ছো নাচের পাশাপাশি পাইক নৃত্য জনপ্রিয়।
পাইক বিদ্রোহ জঙ্গলমহল এলাকায় লোকসংস্কৃতিতে বড় প্রভাব ফেলেছিল। শুধু পাইক নাচে নয়, ঝুমুর গানেও এর প্রভাবের পরিচয় মেলে। এমনই একটি গান, ‘কেশু আড়ির ফাঁসি হইল/রঘুনাথ বাঁধায় গেল/বাঁশ বনে ডম হইল কানা/ রাগে কাঁপিছে জঙ্গলমহল থানা’। কেশু আড়ি এবং রঘুনাথ মাহাতো বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন বলেই তাঁদের এই দশা।
ব্রিটিশরা বহুদিন ভারত ছেড়েছে। চুয়াড় বা পাইক বিদ্রোহের স্মৃতিও জঙ্গলমহলের বাসিন্দাদের মনে কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে। ফলে পাইক নাচেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে। হাল আমলের পাইকনাচ তার সংগ্রামী চরিত্র বা ‘ওয়ার মোটিভ’ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছে। পাইক নাচের রমরমার জায়গাগুলোতে বর্তমানে নাচটি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাকে উপজীব্য করে পরিবেশন করা হয়। এবং এর নান্দনিক সৌন্দর্য, সংগীত-বাদ্য-নৃত্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। হাল আমলের দু’টি পাইক নাচ সংগ্রহ করা গিয়েছে। ‘ধারে ধারে চলরে রাই/কাঙ্গালিনীর মাঠে।/চলিতে চলিতে কোকিলা ডাকে রে ভাই/পাহাড় পর্বত কাটে’। শেষ দৃশ্যে, ‘রাধাকৃষ্ণের মিলন হল শ্যাম দরশনে,/ভ্রমরা–ভ্রমরি বলে আমরা দু’জনে/যাকে শ্যাম দরশনে যুগলমিলনে/রাধাকৃষ্ণের মিলন হলো শ্যাম দরশনে’। পাইক নৃত্যের এই পরিবর্তনের নেপথ্যে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সক্রিয় প্রভাব ছিল বলে মনে হয়।
কিন্তু কেন পাইক নাচ রণবাদ্য ছেড়ে ধীরে ধীরে প্রেম বাঁশরিতে মজে গেল? একটা কারণ বললেন দুবড়া অগ্রগামী পাইক নৃত্যগোষ্ঠীর গুরু পরিমল দলুই। পরিমলবাবু ২০১২ সালে শান্তিনিকেতনে পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি কেন্দ্রের গুরুশিষ্য পরম্পরা কর্মশালায় পাইক নৃত্য নিয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি যা বললেন, তার মূলকথা, বর্তমান দর্শকদের চাহিদা ও অভিরুচি অনুযায়ী পালা করতে হয়। তাঁর ঠাকুরদা কালীপদ দলুই ঢাল–তরোয়াল নিয়ে পাইক নৃত্য করতেন। এখনও কিছু অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে তাঁদের কাছে। সরকার বা লোকনৃত্য নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন চেষ্টা করলে শিল্পীদের তালিম দিয়ে পাইক নাচের আদিরূপটি ফিরিয়ে আনা যাবে বলেই মনে হয়।
পরভা ছো নৃত্যকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা গিয়েছে। সরকারি সাহায্য মেলায় পরভা পুনরুজ্জীবনের কাজ সম্ভব হয়েছিল। পরভার মতোই পাইক নাচের আদিরূপ (রণনৃত্য) ফিরিয়ে আনার জন্য দলটিকে বিষয়বস্তু (চিত্রনাট্য) দেওয়া হয়েছে। কালের নিয়মে ও আঙ্গিককে যুগ উপযোগী করার প্রয়োজনে কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা যায়। তবে মূল মূল সুরকে অবশ্যই অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। নাচটির আদিরূপটির পুনরুজ্জীবনের জন্য লোক প্রথার প্রকল্পে নথিভুক্ত পাইক নৃত্য গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে সরকারি ভাবে কর্মশালা করা যেতে পারে। না হলে বিদ্রোহের সুর মাখা ছন্দে ইতিহাস ধরে রাখা এমন একটি বীরদর্পী নাচ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে।
লেখক লোকসংস্কৃতির গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy