Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আধার বিতর্ক ও নৈতিকতা

গোটা আধার-বিতর্ক আদতে একটি বৃহৎ দার্শনিক তর্ক। যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

রোহন ইসলাম
শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০৫
Share: Save:

অনলাইনে চব্বিশ ঘণ্টা তাঁরা একে অপরকে ‘রেটিং’ দিতে ব্যস্ত। কাউকে ফাইভ স্টার। কাউকে নেগেটিভ। রেটিং-নির্ভর এই ‘প্রোফাইল স্কোর’-এর উপরই নির্ভর করছে তাঁদের একে অপরের ‘সোশ্যাল সিকিয়োরিটি’। প্লেনে চড়ার যোগ্যতা থেকে প্রিয় বন্ধুর বিয়েতে নেমন্তন্নের সম্ভাবনা, সব কিছুই নির্ধারিত করে দিচ্ছে আপনার ব্যক্তি-প্রোফাইলের স্কোর। নেটফ্লিক্সের ‘ব্ল্যাক মিরর’ সিরিজ়ের (‘নোজ়ডাইভ’) এই কল্পরাজ্যে রাষ্ট্র আর নাগরিকের সম্পর্কটা এমনই। প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রিত। রেটিং নির্ভর। ইতিমধ্যেই ‘উবর’-এর মতো বেসরকারি প্রযুক্তি-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চড়তে যাঁরা অভ্যস্ত, তাঁরা বোঝেন এই ‘রেটিং’-এর মর্ম। গাড়ি যিনি চালাচ্ছেন আর যাঁরা চড়ছেন— উভয়ই নির্ভর করেন একে অপরের রেটিং-এর উপর।

এখন ভাবুন, এই গাড়ি আসলে আমাদের এই মহান ভারতবর্ষ। চালকের স্থানে রাষ্ট্র। আর আসনে আপনার-আমার মতো নাগরিক। রেটিং নয়, এই খেলায় একে অপরকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত করার একটিই অস্ত্র, ‘ভোট’। ভোটার কার্ডই ঠিক করে দেয় চালক এবং যাত্রীর স্বস্তির মাপকাঠি। ‘উবর’-এর রেটিং পদ্ধতিতে ব্যবস্থার হুকুম কারও হাতেই নেই। আবার যেন দু’পক্ষের হাতেই রয়েছে। ‘ভোট’ পদ্ধতিতে, চালকের আসনে যিনিই থাকুন না কেন, ব্যবস্থার হুকুম যাত্রীর হাতেই। পরিষেবা পছন্দ না হলে যাত্রীই পারেন চালক পাল্টাতে। ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’। তাই না?

না, এ দেশ মুনাফাসন্ধানী কর্পোরেট সংস্থা নয়। উপভোক্তার প্রতি ‌বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব এবং নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের ফারাক থাকবেই। একটি বারো সংখ্যার ব্যবস্থা কি রাষ্ট্র ও নাগরিকের এই সম্পর্ককে টলিয়ে দিতে পারে? বরাবরের অভ্যেসমতো আপনি গাড়িতে চড়তে চান। এ দিকে চালকের আসনে থাকা সন্দেহবাতিকগ্রস্ত রাষ্ট্র প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায় না আপনি ‘সুনাগরিক’।

রাষ্ট্রের কল্যাণময়ী চেহারার এই আমূল পরিবর্তনে আপনার মানুষ-সত্তা প্রবল ক্ষুব্ধ। আপনি ভোট দিয়ে তাকে চালকের আসন থেকে তাড়াতে চান। কিন্তু রাষ্ট্র বলে দিল— পাল্টে যাকেই আনুন, একই দাবি জানাবেন তিনিও। অগত্যা একটি বিশেষ প্রযুক্তিনিয়ন্ত্রিত নম্বরকে আধার করে পরিষেবা নিতে বাধ্য হলেন আপনি। ব্যবস্থার হুকুম আর আপনার হাতে রইল না। বরং নিয়ন্ত্রণ এবং সম্পর্কের দিক থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠল রাষ্ট্র। উল্টো দিকে, আপনারও আর কেবল নাগরিক হলেই চলল না। আপনি পরিষেবা পেতে পারেন একমাত্র যদি আপনি ‘সুনাগরিক’ হন। নিয়ন্ত্রণের এই শর্তে সায় দিলেই আপনি ‘সুনাগরিক’। ‘অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’?

গোটা আধার-বিতর্ক আদতে একটি বৃহৎ দার্শনিক তর্ক। যার মূলে রয়েছে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক। আধারের ধারণার আগে এই সম্পর্কের চেহারা এক রকম। পরে আর এক রকম। সাম্প্রতিক আধার মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির রায় সম্পর্কের এই পরিবর্তিত রূপকেই মান্যতা দিল। যেখানে রাষ্ট্রের প্রাথমিক রূপ আর কল্যাণময়ী নয়, তার চোখে প্রতিটি নাগরিকই ‘সম্ভাব্য অপরাধী’। প্রযুক্তি ঠিক করে দেয় সেই নাগরিক ভাল না খারাপ। আধারের মূলেই রয়েছে নাগরিক সত্তার ভালমন্দ বিচার। আধারের শর্তে আত্মসমর্পণ করলে আপনি ভাল। না করলে মন্দ। প্রযুক্তি খুব সহজেই সেই বিভেদ স্পষ্ট করে দেয়। সেই শর্ত অনুযায়ী পরিষেবা বণ্টন করে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কি তা হলে এ বার সুনাগরিক-কুনাগরিক ভেদে সন্তান লালনপালন করবে? সন্দেহ নেই, সম্পর্কের এই পরিবর্তন সংবিধানের বুকে এক বিরাট ক্ষত। সংবিধান কি আর জনগণের রইল? না কি রাষ্ট্রের?

সুপ্রিম কোর্টের ৫৬৭ পাতার সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়টি শুরু হয়েছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ কোটেশন দিয়ে, ‘শ্রেষ্ঠত্বের চেয়ে বড় মৌলিকতা’। কিন্তু আধার কেন ‘ইউনিক’— তার ব্যাখ্যা কিছুটা অস্পষ্ট। এই রায়ে পর্যবেক্ষণের ভিত্তি হিসেবে এসেছে ‘ধারণা’। রাষ্ট্রীয় নজরদারি থেকে শুরু করে তথ্য নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত পরিসরের বিঘ্নতা, অর্থ বিল, প্রতিটি প্রশ্নের ক্ষেত্রে ‘ধারণা’র ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রদত্ত তথ্যকে দেখা হয়েছে সন্দেহাতীত ভাবে। গুরুত্ব অর্পিত হয়েছে রাষ্ট্রপ্রদত্ত সাফল্যের পরিসংখ্যানের উপর। উল্টো দিকে, আধারের প্রযুক্তিগত এবং সাংবিধানিক প্রতি-প্রশ্নটি যেন কম গুরুত্ব পেয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, মামলাকারীরা আধারের কোনও বিকল্প দিতে পারেননি। অথচ প্রশ্নটি আধারের বিকল্প নিয়ে ছিল না। ছিল আধার নিয়েই। এই রায়ে দুই মৌলিক অধিকারের দ্বন্দ্বের (ব্যক্তিগত পরিসর, খাদ্য সুরক্ষা) প্রশ্নের যে ভাবে সমাধান করা হয়েছে, অনেক তাত্ত্বিকই তাতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ‘বৃহত্তর নাগরিক স্বার্থে’ যে প্রশ্নটির মীমাংসা করে দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়, তাতে একমাত্র বেসরকারি সংস্থাগুলির তথ্য ব্যবহারের প্রসঙ্গ ছাড়া কোনও অসাংবিধানিকতা চিহ্নিত হয়নি।

পাঁচ বিচারকের সাংবিধানিক বেঞ্চের মধ্যে একমাত্র ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এই সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ের ধারণা-ভিত্তির যুক্তিকে গভীর ভাবে প্রশ্ন করেেছন। মনে করিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যার আনুমানিকতা কখনওই নাগরিক মর্যাদা এবং অধিকারের শর্ত হতে পারে না। নাগরিকের সাংবিধানিক নিশ্চয়তার সঙ্গে প্রযুক্তিকে জুড়ে দেওয়া চলে না।

গোটা আধার পর্বের সাফল্য এই যে, এর সূত্রেই মৌলিক অধিকার রূপে আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকারের প্রাপ্তি ঘটল। সেই অধিকারই মনে করিয়ে দিল, ‘সাংবিধানিক নৈতিকতা’র প্রশ্নটি কত মৌলিক। আবার মুশকিলও বাধল সেখানেই। সাংবিধানিক নৈতিকতার যুক্তির সঙ্গে ‘আধার’ব্যবস্থার যুক্তিটি মিলল কি?

ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Aadhar Controversy Supreme Court Verdict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE