এপ্রিল অতঃপর আর কেবল নিষ্ঠুরতম মাসই নহে, দেশের হাইওয়ের দুই ধারে শুষ্কতম অনন্তকালের সূচনালগ্নও বটে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে পয়লা এপ্রিল হইতে ভারতের সব হাইওয়ের ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকা মদ্যের দোকান ও পানশালা বন্ধ হইয়া গেল। মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাইবার ফলে দুর্ঘটনার সংখ্যা দেশে ক্রমবর্ধমান। সেই মারাত্মক প্রবণতায় রাশ টানিতেই শীর্ষ আদালতের এ হেন সিদ্ধান্ত। যুক্তি বলিবে, পথপার্শ্বে মদ্য না মিলিলে পান করিবার প্রবণতা খানিক হইলেও কমিবে। চোখের সম্মুখে নেশার দ্রব্য থাকিলে যে নেশা চাগাইয়া উঠে, তাহা অনস্বীকার্য। কিন্তু, যে ভারতীয় জীবনে অন্তত এক বার ‘ড্রাই ডে’-র আগের দিন মদ্যের দোকানের সম্মুখে ক্রেতাদের সর্পিল লাইন প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, তিনি কি আর কখনও বিশ্বাস করিবেন, মদ্যের দোকানের ঝাঁপ ফেলা থাকিলেই মদ্যপান বন্ধ হইয়া যায়? অনুমান হয়, লাইসেন্সধারী দোকানগুলি বন্ধ হইয়া যাইবার পরই স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তার ধারে মদ্যের বোতল লইয়া গাড়িচালকদের অপেক্ষায় থাকিবেন। তাহাতে খরচ খানিক বাড়িবে, এইমাত্র। সহজতর পন্থাও আছে— হাইওয়ের ধারে মদ্য পাওয়া যাইবে না, অথবা বর্ধিত মূল্যে কিনিতে হইবে, জানা থাকিলে আগেভাগেই বোতল গাড়িতে তুলিয়া লওয়া। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখিয়াও প্রশ্ন করা প্রয়োজন, হাইওয়েতে মদ্যপ অবস্থায় গাড়িচালনা বন্ধ করিবার জন্য নজরদারির পরিমাণ বৃদ্ধি এবং অপরাধ প্রমাণিত হইলে কঠোরতর শাস্তির ব্যবস্থা করাই কি অধিকতর বিচক্ষণতার পরিচয় হইত না?
সুপ্রিম কোর্টের আদেশটি গাড়িচালকদের কতখানি বিচলিত করিয়াছে, তাহা এখনও অজ্ঞাত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গাদি রাজ্যের প্রশাসকদের রাত্রের ঘুম ছুটিয়া গিয়াছে। মদ্য রাজ্যের রাজস্বের একটি বড় উৎস, ফলে উদ্বেগ স্বাভাবিক। কিন্তু, তাহাদের প্রতিক্রিয়া একাধারে হাস্যকর ও বিপজ্জনক। সুপ্রিম কোর্টের আদেশ শুধু মদ্যের দোকানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, পানশালার ক্ষেত্রে নহে— এমন একটি অহেতুক বিশ্বাসে ভর করিয়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের হাইওয়ের ধারে থাকা সমস্ত মদ্যের দোকানকে ‘অন শপ’ ঘোষণা করিয়া দিতেছিল। যেখানে মদ্যপানেই আদালতের আপত্তি, সেখানে ‘অফ শপ’ আর ‘অন শপ’-এর মধ্যে ফারাক থাকিবে কেন, রাজ্যগুলি ভাবিয়া দেখে নাই। আদালত জানাইয়া দিয়াছে, ফারাক নাই। ইস্টার্ন বাইপাসের পার্শ্ববর্তী হোটেলগুলিকে বাঁচাইতে রাজ্য সরকার এই রাস্তাটির অংশবিশেষকে রাজ্য সড়কের তালিকা হইতে সরাইয়া লইয়াছে। এমন সিদ্ধান্ত রাজ্যের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের পরিপন্থী হইবে কি না, সে প্রশ্ন যথেষ্ট বিবেচিত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ মেলে নাই।
রাজ্য সরকারগুলি সুপ্রিম কোর্টের আদেশটিকে পাশ কাটাইতে কেন উতলা হইতেছে, তাহার দুইটি যুক্তি মিলিতেছে। এক, মদ্যের দোকান বন্ধ হইলে রাজ্যের রাজস্ব কমিয়া যাইবে; দুই, বন্ধ হইয়া যাওয়া দোকান ও পানশালাগুলির সহিত যাহাদের জীবিকা জড়িত, তাহাদের ক্ষতি। দুইটি যুক্তিই গোলমেলে। সত্যই যদি দোকান বন্ধ করিয়া দিলে হাইওয়েতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে, তবে প্রথমত রাজস্বের ক্ষতি হইলেও তাহা মানিয়া লইতে হইবে; এবং দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনে পানশালার কর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিতে হইলেও ব্যবসাটি বন্ধ করিয়া দিতে হইবে। নচেৎ, কর্মীর জীবিকা নষ্ট হইবার অজুহাতে সমস্ত বিপজ্জনক ব্যবসাই চালাইতে দিতে হয়। রাজ্য সরকারের তরফে যদি কোনও যুক্তি পেশ করিবার থাকে, তবে তাহা এই রূপ— মদ্যের দোকান ও পানশালা বন্ধ করিলে হাইওয়েতে দুর্ঘটনা কমিবে, তাহার কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ নাই। এই আপত্তিটি প্রতিষ্ঠা করিতে পারিলেই তর্ক সম্ভব, নচেৎ আদালতের আদেশ মানিয়া লওয়াই বিধেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy