ধর্মঘটে এ-বার সাড়া মিলবে, সেটা অজানা ছিল না। তবু, সাড়া মিলেছে, এটা ভরসা দেয়। বাড়তি ভরসা দেয় তরুণদের ভূমিকা। কিন্তু এতেই ধর্মঘট সফল বলে সন্তুষ্ট হওয়ার হেতু নেই। যে দাবিদাওয়া নিয়ে ধর্মঘট ডাকা, সে-সব আদায়ের সম্ভাবনা কতখানি? বিশেষ করে রাষ্ট্রশক্তির ঔদ্ধত্য যখন অপরিমেয়? ধর্মঘটকে সংগ্রামের শেষ হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। মুশকিল হল, ব্রহ্মাস্ত্রের দায় বড় বেশি— তাকে যুদ্ধ জিততেই হবে, না হলে ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে।
তবে, ধর্মঘটকে শেষ হাতিয়ার বলে গণ্য না করে যদি তাকে চেতনায় শান দেওয়ার প্রকরণ মনে করি, তা হলে সাফল্যের হিসেবটা পাল্টে যেতে পারে। ধর্মঘটের প্রস্তুতি, তার উদ্যাপন এবং পরবর্তী কর্মকাণ্ড, সবটাই তো জনসংযোগ ও সংগঠনের পথ, যে পথে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা বহু মানুষের কাছে নিজেদের কথা পৌঁছে দিতে পারেন, বহু মানুষের কথা শুনতে পারেন, সেই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে জনচেতনা সমৃদ্ধ হতে পারে, সমৃদ্ধ হতে পারে নেতা এবং কর্মীদের চেতনাও। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার কিছু কিছু নজির আমরা দেখেছি— পত্রপত্রিকায়, রাস্তাঘাটে, সমাজমাধ্যমে ধর্মঘটের দাবিদাওয়া নিয়ে, এবং তার সঙ্গে জড়িত অন্য কিছু কিছু দাবি নিয়েও, প্রচার চলেছে। জনসংযোগের ব্যাপ্তি ও গভীরতা যথেষ্ট ছিল, এমনটা বলা চলে না। মানুষের কথা শোনার অভ্যেস আমাদের রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের ধাতে নেই, তাই সে-কথা আপাতত থাকুক, কিন্তু অন্তত কেন এই ধর্মঘট সে-বিষয়ে মানুষকে আরও অনেক বেশি ওয়াকিবহাল করার সুযোগ ছিল। অতিমারির কথা মনে রেখেও বলা যায়, সেই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। কিন্তু যতটা হয়েছে, তার দাম কম নয়। ধর্মঘটের নানান দাবি বহু মানুষের গোচরে এসেছে, রাষ্ট্রের জনবিরোধী অভিযানের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কথা শোনা এবং কথা বলার মধ্যে দিয়েই আমরা সচেতন হই। সেটাই মূল্যবান।
এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে মহামূল্যবান। রাজ্যে নির্বাচন আসছে। সেই নির্বাচন কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, রীতিমতো জটিল। জটিলতা আগেও ছিল, কিন্তু নানা কারণে এ-বারের পরিস্থিতি প্রায় অভূতপূর্ব। ইতিমধ্যেই রাজনীতির দরিয়ায় ভোটতরঙ্গ প্রকট হয়ে উঠেছে, রকমারি চোরা ঘূর্ণির উৎপাত চলছে, ছোটখাটো সুনামির আশঙ্কাও প্রকট, অনর্থক জল ঘোলা করার পরিচিত কুনাট্যও চলছে। এ-সব অপ্রত্যাশিত নয়, সমুদ্র মন্থনে কিছু গরল ওঠে বইকি। কিন্তু তার পাশাপাশি উঠে এসেছে একটি মহার্ঘ সত্য। সেটা এই যে, নির্বাচনী রাজনীতিকে অনায়াসে চোরাবালি গ্রাস করতে পারে। সেই সম্ভাবনা প্রতিরোধ করতে হলে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক প্রয়োজনগুলি মেটানোর দাবিকেই সেই রাজনীতির ধ্যানজ্ঞান করে তোলা দরকার, সেই দাবি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করাই এখন প্রথম ও প্রধান রাজনৈতিক কর্মসূচি। শ্রমজীবী মানে কেবল প্রচলিত অর্থে শ্রমিক নয়, জীবিকার জন্য নিজের শ্রমশক্তিই যাঁর সম্বল, তিনিই শ্রমজীবী। এই অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই যে শ্রমজীবী, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।