Advertisement
১১ মে ২০২৪

‘মন্ত্রিত্ব ছাড়ব, তবু আদর্শভ্রষ্ট হব না’, বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী

আদর্শের জন্য কোনও কিছুর কাছেই মাথা নোয়াননি। ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু স্বাধীন দেশে তাঁর আদর্শ ভাবনার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। অজয় মুখোপাধ্যায়ের আদর্শের লড়াই লিখলেন জয়দেব মালাকারঅজয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তমলুকের মালিজঙ্গলে। সাবেকি বনেদিয়ানার ছাপ মাখা বাড়ি।

মহাকরণে আপ্ত সহায়কদের সঙ্গে অজয় মুখোপাধ্যায়।  নিজস্ব চিত্র

মহাকরণে আপ্ত সহায়কদের সঙ্গে অজয় মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

তিনি তখন সেচমন্ত্রী। মাঝে মাঝে যেতেন বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়। কাজ শেষে সেখান থেকে ফিরতেন তমলুকের বাড়িতে। কিন্তু কোনও সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন না। দেহরক্ষী রাখতেন না। একবারের ঘটনা। প্রতিবেশী এবং কংগ্রেস কর্মী অজয় মালাকারকে পুলিশ এসে খবর দিল, মন্ত্রী পুরুলিয়া থেকে ফিরছেন। রাত ১১টার সময়ে নামবেন মেচেদা স্টেশনে। স্টেশনে ট্রেন এল। হঠাৎ মন্ত্রীর গলা, ‘‘এই অজয় আয় আয়, আমি এখানে।’’ ট্রেন থেকে নেমেই আশঙ্কায় মন্ত্রী। বললেন, ‘‘এত রাতে আমি বাড়ি যাব কী করে?’’ অজয় মালাকার একটা ট্যাক্সি জোগাড় করেছিলেন। তিরিশ টাকা ভাড়া। সেই ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরলেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী। তার আগে এক চোট রাগারাগি হয়েছে স্টেশনে। মন্ত্রীকে সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন এসকর্টের কয়েকজন পুলিশ। তাঁদের দেখেই বিরক্ত হন মন্ত্রী। রেগে বলেন, ‘এত রাতে বিরক্ত করতে এসেছে! যাও’।

গাড়ি ছেড়ে মন্ত্রী ট্রেনে যাতায়াত করছেন! এখন এমন ঘটনা একটু কষ্ট কল্পনাই। কিন্তু এমনই ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। একাধিক পরিচয় এই মানুষটির। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। আবার স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু জীবনযাত্রায় একেবারে সরল, সাদাসিধে। যদিও জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তিনি আদর্শের জন্য তাঁকে লড়তে হয়েছে। দিতে হয়েছে মূল্যও।

অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল তমলুকের মালিজঙ্গলে। সাবেকি বনেদিয়ানার ছাপ মাখা বাড়ি। তবে তাঁরা তমলুকের আদি বাসিন্দা নন। আদতে তাঁরা হুগলির বাসিন্দা ছিলেন। বাবা শরৎ মুখোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী। আইন ব্যবসার কারণেই শরৎ মুখোপাধ্যায় তমলুকে আসেন। তিনি তমলুক বার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকও হয়েছিলেন। তরুণ অজয় স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর ডাকে অসহযোগ, আইন অমান্য এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে সাড়া দিয়েছিল তমলুক। সেই আন্দোলনের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের একজন ছিলেন অজয় মুখোপাধ্যায়। ১৯৪২ সালের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তমলুকে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। কারণ ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর স্বাধীন‘মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার’ ঘোষণা হয়েছিল। স্বাধীন সরকার গঠনের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন তিনি। সরকারের সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব নেন। পরে তিনিও গ্রেফতার হন। মুক্তি পেয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ছায়া মন্ত্রিসভার চেষ্টায়।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তার পর দেশ স্বাধীন হল। ১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ উপনির্বাচনে তমলুক বিধানসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থী হলেন। দাঁড়াতে হল নিজের ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বিশ্বনাথ ছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী। অজয় মুখোপাধ্যায় হলেন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিসভার সেচ ও জলপথ বিভাগের মন্ত্রী। গ্রাম বাংলার নদী-নালা সংস্কারের কাজ শুরু করেছিলেন। তমলুক মহকুমার জগন্নাথখালি, সোয়াদিঘি, প্রতাপখালি, গঙ্গাখালি, পায়রাটুঙ্গি, বাঁপুর খাল সংস্কার করেন। তাতে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় কৃষিক্ষেত্রে উন্নতিতে সহায়ক হয়। অজয় মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাতেই তমলুকে ১৯৬২ সালে ১২ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১২৫ শয্যার মহকুমা হাসপাতাল তৈরি হয়। বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পরে প্রফুল্লচন্দ্র সেনের মন্ত্রিসভাতেও তিনি সেচ এবং জলপথের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু এই সময়ে দুর্নীতি-সহ নানা কারণে কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়। দলের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে মাদ্রাজের মুখ্যমন্ত্রী কামরাজের নেতৃত্বে একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় কংগ্রেস শাসিত রাজ্যে মন্ত্রিসভার সদস্য কমানো হবে এবং নেতাদের সাংগঠনিক কাজ করতে হবে।

মন্ত্রিত্ব থেকে সরতে হয় অজয় মুখোপাধ্যায়কে। জনমানসে দলের আস্থা ফেরাতে মেদিনীপুরের কংগ্রেস সভাপতি গ্রামেগঞ্জে সভা করতে শুরু করেন। কিন্তু দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রবল। তাঁকে জেলা কংগ্রেস এবং রাজ্য সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। যার ফলে বাংলা কংগ্রেস দলের জন্ম। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার শ্যামস্কোয়ারে কর্মী সম্মেলনে জন্ম হয় নতুন দলের। ফলে কংগ্রেসের সদস্যপদ যায় তাঁর। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বাংলা কংগ্রেস-সহ চার দলের ‘পিপলস ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট’ গঠন করেন। ওই নির্বাচনেই অজয়বাবুর মুখ্যমন্ত্রিত্বে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। কিন্তু সরকার টেকেনি একাধিক কারণে। অন্তর্বর্তী নির্বাচনেও মুখ্যমন্ত্রী হন। রাজ্যের পরিস্থিতি ভয়াবহ। নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশে নিজের সরকারকে ‘অসভ্যের সরকার’ আখ্যা দিয়ে ১৯৬৯ সালের ১ ডিসেম্বর কার্জন পার্কে বাংলা কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে অনশন সত্যাগ্রহে বসেন। তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা ছিল, ‘আইনশৃঙ্খলার উন্নতি না হলে ছেঁড়া জুতোর মতো মন্ত্রিত্ব ছেড়ে চলে যাব। তবুও আদর্শভ্রষ্ট হব না’। পদত্যাগ করেন। বেতার ভাষণে বলেন, ‘এই অবস্থায় গদি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা মানে জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা’।

কিন্তু সংসদীয় রাজনীতির জীবন বারবারই বাধা পেয়েছে। একসময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন নিজের মন্ত্রিসভার উপমুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বিরুদ্ধে। তবে বরানগর কেন্দ্রে তিনি জ্যোতি বসুর কাছে পরাজিত হন। তমলুকে জয় আসে। ১৯৭১ সালে তৃতীয়বার মুখ্যমন্ত্রী হলেও সরকারের পতন হয় দ্রুত। মাত্র ৮৩ দিনে। ফিরেছিলেন কংগ্রেসে। ’৭২ সালে তমলুক থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কাজকর্ম থেকে সরে যাচ্ছিলেন। ’৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোদ্ধা সতীশ সামন্ত সুশীলকুমার ধাড়ার কাছে পরাজিত হলে তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন। তমলুক ছেড়ে কলকাতায় এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যান।

সরল ছিল জীবনযাপন। নিরামিষ খেতেন। পরনে চটি জুতো। হাঁটুর উপর পর্যন্ত খদ্দরের কাপড় আর হাতকাটা জামা পরতেন। ভাই বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন। তাঁর স্ত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়ও রাজ্য রাজনীতির নামী মুখ। সকলেই থাকতেন একই বাড়িতে। অজয় মালাকার প্রতিবেশী এবং কংগ্রেস কর্মী। অজয়বাবুর সঙ্গী ছিলেন। মেচেদা স্টেশনে মন্ত্রীর রাতে ফেরার সাক্ষী অজয় এই প্রতিবেদকের দাদা। সহকর্মী অজয় একটি ঘটনার কথা জানান। তমলুকে রাজ ময়দান আর কোর্ট প্রাঙ্গণে দামু (বিশ্বনাথ) আর দাদার মিটিং। পরস্পরকে দোষারোপ। কিন্তু বাড়ি ফিরে খেতে বসার আগে ছোটভাই দামুর খোঁজ। নারকেল মুড়ি ভালবাসতেন। অনেক সময়ে রাতে ফিরে দেখতেন খাবার ব্যবস্থা নেই। নারকেল মুড়ি দিয়ে আসতেন মালাকার অজয়।

শেষ জীবনে কন্যাসমা নার্স রাঁচির আদিবাসী কন্যা তিরু দেখাশোনা করতেন। ১৯৮৬ সালে ২৭ মে মারা যান। শেষদিনের একটি ছবিতে দেখা যায়, বাঁশের খাটিয়ায় শোয়ানো রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দড়ি দিয়ে বাঁধা। রয়েছেন গীতা মুখোপাধ্যায়, সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর হাঁটু গেড়ে হরিপদ দোলই। হরিপদ তমলুকের কংগ্রেস অফিসে রান্না করতেন। হরিপদ তমলুকে ফিরে জানান, শেষযাত্রার দিনে প্রণব মুখোপাধ্যায় পকেট থেকে ৫০ টাকা বের দিয়েছিলেন। শেষযাত্রার খাট নিয়ে আসতেন। এনেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কিন্তু দেহ আসেনি তমলুকে।

লেখক প্রাবন্ধিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Ajoy Mukherjee Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE