Advertisement
০২ মে ২০২৪
‘দূত’ পাঠানো হয়েছে বহু বার, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান হয়নি

ছররা বন্দুকে ঝাঁঝরা করার পরে ‘গলে লাগ যা’!

কাশ্মীরে ’৮৭-র বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়, ব্যাপক রিগিং হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। কাশ্মীর বেশ কয়েক বছর রাজ্যপালের শাসনাধীন থাকে।

এক দিকে সন্ত্রাস, অন্য দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর ভারী বুট— পিষ্ট হতে থাকা কাশ্মীরিদের যন্ত্রণাটা বোঝার চেষ্টা হচ্ছে কি? —প্রতীকী ছবি / রয়টার্স।

এক দিকে সন্ত্রাস, অন্য দিকে নিরাপত্তা বাহিনীর ভারী বুট— পিষ্ট হতে থাকা কাশ্মীরিদের যন্ত্রণাটা বোঝার চেষ্টা হচ্ছে কি? —প্রতীকী ছবি / রয়টার্স।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

বে চারা পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম! কাশ্মীর নিয়ে কী-ই বা এমন দোষের কথা বলেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? বলেছেন, কাশ্মীরিদের বড় অংশ আজাদি বলতে স্বায়ত্তশাসনের কথাই বোঝেন। সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ মেনে তাঁদের আরও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া যেতেই পারে। তিনি তো কোথাও বলেননি যে, ‘আজাদি’ মানে স্বাধীন কাশ্মীরকে মেনে নেওয়া। কিন্তু, সে কথা শুনবে কে? গুজরাত ও হিমাচল প্রদেশে নির্বাচন এসেছে। এই সময়ে এমন বেলাগাম মন্তব্যের ফসল বিজেপি তুলবে না, তা কি হয়? অতএব, চিদম্বরম তথা গোটা কংগ্রেসকেই কাঠগড়ায় তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতৃত্ব প্রত্যাশিত ভাবেই বলেছেন, কংগ্রেস কাশ্মীরে যে ভাষায় কথা বলছে, সেই ভাষা তো উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির কাছ থেকে বা পাকিস্তানের মাটিতে শোনা যায়। মোদীকে বড় একটা দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, এমন বেমক্কা সুযোগ তিনি ছাড়বেনই বা কেন? কংগ্রেস হলেই কি ছাড়ত?

কিন্তু গুরুতর প্রশ্নটা হল, এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের কী ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল? দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার পাশে না দাঁড়িয়ে বরং নিজেদের পিঠ বাঁচাতে কংগ্রেস রীতিমত বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিল, জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, চিদম্বরমের বক্তব্য একান্ত ভাবেই তাঁর নিজের— দলের নয়।

কংগ্রেস কি মেরুদণ্ড একেবারে জলাঞ্জলি না দিয়ে যুক্তির কথা বলতে পারত না? চিদম্বরমের পাশে দাঁড়িয়ে কংগ্রেস কি এক বারও বলতে পারত না, কী এমন ভয়ংকর কথা বলেছেন তিনি? সংবিধানের গণ্ডির মধ্যে থেকেই ৩৭০ ধারাকে মর্যাদা দিয়ে উপত্যকায় আরও স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার ভাবনার কথাই বলেছেন। কিন্তু, ঠিকই তো, কংগ্রেস এ কথা বলবেই বা কী করে? বিজেপির যেমন সামনে ভোট, কংগ্রেসেরও তো তা-ই! অতএব, জাতীয়তাবাদের পিঠে সওয়ার হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। তাই যে নেতাকে কংগ্রেস বরাবর আক্রমণের মুখ হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে, সেই চিদম্বরমের পাশ থেকে সরে যেতেও তাদের বেশি দেরি হয়নি।

কাশ্মীরকে নিয়ে রাজনৈতিক তরজা উত্তুঙ্গ হবে, এটাও স্বাভাবিক। বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যা ও জাতীয়তাবাদকে এক করে বিজেপি তাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে, বিরোধী দলগুলির পক্ষে তার বিরোধিতা করা সত্যিই মুশকিল।

আরও একটা প্রশ্ন এই তরজার মধ্যেই উঁকিঝুকি দেয়। কাশ্মীরিদের আত্মমর্যাদাবোধ নেই? দিল্লির কর্তারা চিরকাল অনুদান বা ডোল দেওয়ার ঢঙে কাশ্মীরিদের ‘পাশে থাকা’র কথা বলে যাবেন? সব সময় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি ধামাচাপা পড়বে? আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বললেই মনে হবে, কাশ্মীরিরা পাকিস্তানে যাওয়ার জন্যই মুখিয়ে আছেন? আলোচনার পথ খুলতে সম্প্রতি বিশেষ দূত নিয়োগ করেছে কেন্দ্র। প্রাক্তন গোয়েন্দাপ্রধান দীনেশ্বর শর্মাকে নিয়োগ করে তাঁকে ‘সব পক্ষ’-র সঙ্গে কথা বলার অধিকার দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হবে তো? উপত্যকার গোটা প্রেক্ষাপট কি আলোচনার জন্য প্রস্তুত? না ছররা বন্দুকের (পেলেট গান) প্রদর্শনীর পরে ‘গলে লাগ যা’ বললেই কাশ্মীরিরা গলে যাবেন?

১৯৯০ সালে, কাশ্মীরে যখন বিদেশি মদতে জঙ্গিয়ানার দাপট শুরু হয়েছে সে সময়ে দীনেশ্বর সেখানে ছিলেন। পরে গোয়েন্দা বিভাগের কাশ্মীর ডেস্কের দায়িত্বেও ছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা এত দিনে বোধহয় সকলের কাছেই স্পষ্ট। দিল্লি চায়, কাশ্মীরিরা এই সার সত্যটুকু বুঝুক যে, শুধু হিংসাত্মক আন্দোলন করে ও জঙ্গিপনার আশ্রয় নিয়ে কোনও লাভ নেই। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান বাইরে থেকে যে মদতই দিক না কেন, তা বরদাস্ত করা হবে না। তাই কড়া অবস্থান নিয়ে কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীদের একের পর এক খতম করার পাশাপাশি জাতীয় তদন্তকারী সংস্থাকে (এনআইএ) দিয়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ নেতাদের উপর চাপ বাড়ানো এবং বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের লোকজনকে গ্রেফতার— বিভিন্ন ভাবে পাল্টা আক্রমণের পথ নিয়েছে বিজেপি সরকার। এরই সঙ্গে চলছে পাকিস্তানের উদ্দেশে বিষোদ্গার করে আন্তর্জাতিক মহলে তার উপর চাপ বাড়ানোর প্রয়াস।

এই আবহেই বিশেষ দূত হিসেবে দীনেশ্বরকে নিয়োগ করে সরকার বোঝাতে চায়, চাপের কাছে নতিস্বীকার করে আলোচনার টেবিলে বসুক বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। ইতিহাস কিন্তু বলছে, নানা জমানায় দিল্লীশ্বরেরা কাশ্মীরে মধ্যস্থতাকারী বা বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন। যেমন, স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রথম দশকে, ১৯৫৩ সালে শেখ মহম্মদ আবদুল্লা ফের জম্মু ও কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে কাশ্মীরে পাঠান। এর কয়েক মাস পরে শেখ আবদুল্লা ক্ষমতাচ্যুত হন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগে কারাবন্দি করা হয় তাঁকে। ’৬৪ সালে কাশ্মীর যখন অশান্ত, সে সময়ে নেহরু প্রথমে সেখানে পাঠান তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান বি এন মল্লিককে। পরে যান লালবাহাদুর শাস্ত্রী। সত্তরের দশকে কাশ্মীরের স্বশাসনের দাবি যখন ফের জোরদার, ইন্দিরা গাঁধী পাঠিয়েছিলেন কূটনীতিক জি পার্থসারথিকে। তৈরি হয়েছিল ইন্দিরা-আবদুল্লা চুক্তির পটভূমি।

কাশ্মীরে ’৮৭-র বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে বিস্তর বিতর্কের সৃষ্টি হয়, ব্যাপক রিগিং হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। কাশ্মীর বেশ কয়েক বছর রাজ্যপালের শাসনাধীন থাকে। ’৯৬ সালে আবার নির্বাচন হয়। ওই অশান্ত সময়েও জর্জ ফার্নান্ডেজ ও রাজেশ পাইলট নিয়মিত ভাবে কাশ্মীরে যেতেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় ২০০১ সালে কে সি পন্থ কমিটি তৈরি হয়। যদিও সে বছরেরই ডিসেম্বরে সংসদ ভবনে জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে সে চেষ্টায় ইতি পড়ে। ২০০২-এ রাম জেঠমলানীর নেতৃত্বে কাশ্মীর কমিটি তৈরি হয়। সেই কমিটির কাজকর্মও বড় একটা এগোয়নি। ২০০৩-এ আবার প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব এন এন বোহরাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিয়োগ করে বাজপেয়ী সরকার। ২০০৮-এ জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল পদে বসার আগে পর্যন্ত তিনি ওই ভূমিকাই পালন করেছেন। এর পরেও নানা সময়ে অরুণ জেটলি, আর কে মিশ্র, ‘র’-এর প্রাক্তন প্রধান এ এস দুলত— অনেককেই উপত্যকার সমস্যা মেটাতে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি।

২০১০-এও ইউপিএ জমানায় দিলীপ পদগাঁওকর, রাধা কুমার এবং এম এম আনসারিকে নিয়ে গঠিত মধ্যস্থতাকারীদের একটি কমিটি যা যা সুপারিশ করেছিল, মনমোহন সিংহ সরকার সে সব খারিজ করে দেয়।

এ বার কী হবে? হুরিয়ত ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা দীনেশ্বর শর্মার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়। কারণ, তার আগে ভারত সরকারকে স্বীকার করে নিতে হবে যে, কাশ্মীর বিতর্কিত এলাকা। বিজেপি সরকারের মনোভাব নিয়েও সন্দিহান হুরিয়ত নেতৃত্ব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোরালো। এই ঘোরালো পরিস্থিতির মধ্যেই কাশ্মীরের মাটি জরিপ করতে যেতে হচ্ছে প্রাক্তন গোয়েন্দাকর্তাকে।

কাশ্মীরের জমি হয়তো অনেকেই চেনেন, কোন জেলার কোন যুব সম্প্রদায়ের হাতে ওঠা পাথরের ব্যাস কত, তা-ও তাঁদের কণ্ঠস্থ। শুধু কাশ্মীরের মানবজমিনের আনাচকানাচের সন্ধান আরও একটু আন্তরিকতার সঙ্গে জানতে চাইতেন তাঁরা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE