Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মর্মান্তিক

এতগুলি প্রাণের দায় কি সত্যই লাইনে আসিয়া পড়া ট্রেনের উপর চাপাইয়া দেওয়া যায়? লাইনে ধাবমান ট্রেনে আচমকা ব্রেক কষিলে আরও বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকিত কি না, তাহাও বিবেচনাসাপেক্ষ।

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১৫
Share: Save:

চল্লিশ বৎসর ধরিয়া যে দুর্ঘটনা ঘটে নাই, এই দশেরার দিন ঘটিল। রেললাইনের উপর দাঁড়াইয়া দশেরার রাবণদহন দেখিতে, সেলফি তুলিতে মগ্ন ছিলেন বহু মানুষ। সরিবার অবকাশ পাইলেন না তাঁহারা। মৃতের সংখ্যা এখনও বাড়িয়াই চলিতেছে। দেশটির নাম যখন ভারত, যে কোনও মৃত্যু লইয়াই রাজনৈতিক তর্জা চলিবে। কিন্তু, এতগুলি প্রাণের দায় কি সত্যই লাইনে আসিয়া পড়া ট্রেনের উপর চাপাইয়া দেওয়া যায়? লাইনে ধাবমান ট্রেনে আচমকা ব্রেক কষিলে আরও বড় দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকিত কি না, তাহাও বিবেচনাসাপেক্ষ। অতএব, কেন চালক সময়ে ট্রেন থামাইলেন না, সেই প্রশ্ন করিবার পূর্বে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন, যাঁহারা রেললাইনের উপর নিশ্চিন্তে বসিয়াছিলেন, তাঁহারা কি জানিতেন না যে এই লাইনে ট্রেন চলে? অনুষ্ঠানটির আয়োজকরা কি জানিতেন না যে কী মারাত্মক দুর্ঘটনার ব্যবস্থা তাঁহারা করিয়া রাখিয়াছেন? উত্তরে বলা হইবে, প্রতি বৎসরই তো এই ভাবেই দশেরার অনুষ্ঠান হইত। স্থানীয় রেলকর্মীরা যথাসময়ে ট্রেন থামাইয়া দিতেন, লাইনের উপর হইতে সরিবার সময় পাইত জনতা। তাহার পর ট্রেন যাইত। আয়োজকরা হয়তো প্রশ্ন করিবেন, এত দিনের এই প্রথা এই বার ভাঙিবে, তাহা কে জানিত? অতএব, এই দুর্ঘটনার মূলে যদি পৌঁছাইতে হয়, তবে তাহা ২০১৮ সালের দশেরায় নহে, খুঁজিতে হইবে অন্যত্র। কেন এমন একটি অকল্পনীয় দুর্ঘটনা ঘটিতে পারে, তাহা বুঝিতে গেলে ভারতীয় মনটিকে চেনা প্রয়োজন।

ভারত যেমন ভাবে চলে, ধোবি ঘাটের দশেরাও ঠিক সেই ভঙ্গিতেই চলিত— যাহাকে বলে, ‘চলতা হ্যায়’। একটি ছোট মাঠে অনুষ্ঠান আয়োজিত হইত, সেই মাঠে প্রবেশ ও প্রস্থানের পথ অপরিসর। এবং সেই অনুষ্ঠানের বহর প্রতি বৎসরই বাড়িত। সংবাদে প্রকাশ, এই বাৎসরিক জনসমাগমের জন্য প্রশাসনিক ছাড়পত্র লওয়া হইত না, রেলকে জানানো হইত না। শুধু স্থানীয় রেলকর্মীদের সহিত বোঝাপড়া ছিল, তাঁহারা ট্রেন থামাইয়া দিতেন। ভাবিয়া দেখিলে, দৈব অনুগ্রহে প্রশ্নহীন বিশ্বাস ব্যতীত জীবনের এই বিপুল ঝুঁকি লইয়া মানুষ দশেরার উৎসবে মাতিতেন না। কিন্তু, ইহাই ভারত। যত ক্ষণ অবধি বিপদ না ঘটিতেছে, তত ক্ষণ সতর্ক হওয়া এই দেশের ধাতে নাই। বাগড়ি বাজারের জতুগৃহই হউক, উত্তরাখণ্ড বা কেরলে নদীর পথ রুধিয়া বসতিনির্মাণই হউক অথবা অমৃতসরে রেললাইনে বসিয়া দশেরা উপভোগ— নিজের জীবনকে যথেষ্ট মূল্যবান জ্ঞান করিতে ভারতীয়রা শিখে নাই। তাঁহাদের অটল বিশ্বাস, ‘ও কিছু হইবে না’। বিশ্বাসটি যে কতখানি ঠুনকা, বারংবার ঠেকিয়াও মানুষ শিখে নাই। আশঙ্কা হয়, এই বারও শিখিবে না। আরও বিপর্যয়ের অপেক্ষায় দিন গনিবে এই দেশ।

রেলবোর্ড জানাইয়াছে, কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটি এই দুর্ঘটনার তদন্ত করিবে না, কারণ ইহা ‘রেল দুর্ঘটনা’ নহে, বরং রেলের এলাকায় অনধিকার প্রবেশের ফলে ঘটা দুর্ঘটনা। কথাটি শুনিতে কঠোর, কিন্তু অনেকাংশে সত্য। রেললাইন বস্তুটি যে হেতু জনবসতির মধ্য দিয়াই যায়, ফলে বহু মানুষই তাহাকে নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ, অতএব অধিকারভুক্ত, হিসাবে দেখেন। সেই অধিকারবোধে তাঁহারা ভুলিয়া যান যে পরিসরটি খেলার মাঠ বা পাড়ার পুকুরের ন্যায় নিরাপদ নহে। গোটা দেশের সব রেললাইন পাহারা দেওয়া অসম্ভব, ফলে সেই পরিসরে অনধিকারপ্রবেশ ঠেকাইবার উপায় রেল বা প্রশাসনের নাই। কাজেই, বহু মানুষ রেললাইনকে ঘরবাড়ি রাস্তাঘাটের পরিসর করিয়া লইতে এমনই অভ্যস্ত হইয়াছেন যে ট্রেনের শব্দেও তাঁহাদের হুঁশ ফিরে না, মৃত্যু-সম্ভাবনা নামক বিপদের কথাটিও ভুলাইয়া দেয়। এই ঘটনা মর্মান্তিক। কিন্তু, ইহাকে অপ্রত্যাশিত বলা চলে না, প্রায় অবধারিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Train Accident Amritsar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE