এক ঠান্ডা পানীয় সংস্থা একটি বিজ্ঞাপন প্রস্তুত করিয়াছিল, টেলিভিশন ও অন্যত্র দেখাইবার নিমিত্ত, যেখানে বিখ্যাত মার্কিন ম়ডেল কেন্ডাল জেনার দেখিতেছেন, একটি প্রতিবাদ মিছিল চলিতেছে, তিনি একটি ফোটো-শুট’এ ব্যস্ত ছিলেন, কিন্তু সকল কাজ ছাড়িয়া তিনিও মিছিলে অংশ লইতে আসেন। অংশীরা প্রায় সকলেই তরুণ-তরুণী, তাহাদের সম্মুখে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছে। সুন্দরী জেনার অগ্রসর হইয়া এক পুলিশের হাতে নির্দিষ্ট কোম্পানির ঠান্ডা পানীয় তুলিয়া দেওয়ায়, পুলিশটি হাসিয়া ফেলেন, সমবেত প্রতিবাদীরাও হইহই করিয়া উঠেন উল্লাসে, এবং পরস্পরকে আলিঙ্গন শুরু করেন। প্রকাশিত হওয়া মাত্র বিজ্ঞাপনটি লইয়া এমন হুলস্থুল হইয়াছে, সংস্থাটি উহা প্রত্যাহার করিয়া লইয়াছেন। বহু মানুষ বিজ্ঞাপনটির মধ্যে প্রতিবাদকে লঘু করিয়া দেখাইবার প্রবণতা লক্ষ করিয়াছেন। পুলিশের হস্তে নরম পানীয় তুলিয়া দিলেই যদি প্রতিবাদ সফল হইয়া যাইত এবং রাষ্ট্রশক্তি ও প্রতিবাদী জনতার সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হইত, তবে তো আর ভাবনা ছিল না। আমেরিকায় ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের অগ্রণী সক্রিয় কর্মী বলিয়াছেন, ‘কে জানিত, আমি হস্তে উক্ত কোম্পানির পানীয়টি ধরিয়া রাখিলেই আর গ্রেফতার হইতাম না!’ মার্টিন লুুথার কিং জুনিয়র-এর কন্যা, পুলিশের সহিত মার্টিন লুথারের একটি প্রতিবাদ চলাকালীন মোকাবিলার ছবি পোস্ট করিয়া লিখিয়াছেন, ‘কেবল যদি বাবা জানিতেন এই পানীয়টির ক্ষমতা সম্পর্কে’!
ছবিটিতে প্রতিবাদ মিছিলটিকে দেখানো হইয়াছে যেন উহা এক মহানন্দময় সমাবেশ, যাহাতে কমবয়স্করা অতি উৎসাহে যোগ দিতেছে। প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে উত্তেজক ও তাহা হইতে কেবলই গাম্ভীর্য বিকীর্ণ হইতে হইবে তাহার অর্থ নাই, কিন্তু তাহা বলিয়া আন্দোলনকে বনভোজনের ফুরফুরে দীপ্তি দান করাও চলে না। প্রতিবাদীদের মধ্যে থাকে অন্যায়ের প্রতি ক্ষোভ ও তাহার প্রতিকারের প্রতিজ্ঞা, তাহার সহিত থাকে ক্ষমতার সহিত সম্ভাব্য সংঘর্ষের উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক। কেহ হয়তো কাঁদানে গ্যাসের আক্রমণ ঠেকাইতে ভিজে কাপড় লইয়া যাইতেছে, কেহ পরিকল্পনা করিতেছে গ্রেফতার হইলে কাহারা প্রথম সারিতে থাকিবে, কেহ ভাবিতেছে পুলিশ লাঠিচার্জ করিলে কোন পন্থা অবলম্বন করা হইবে। প্রতিবাদীদের দেখিয়া সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আহাবাহা করা যত সহজ, রাস্তায় নামিয়া প্রতিবাদ করা তত মিষ্ট অভিজ্ঞতা নহে। প্রতিবাদী জানে, কঠোর হস্তে তাহাকে দমন করিবার চেষ্টা হইবে, এবং তাহা অতিক্রম করিবার সাহস তাহাকে সংগ্রহ করিতে হইবে। তাই যখন কোনও বিজ্ঞাপন বলে, একটি পানীয় ভাগ করিয়া লওয়াই শাসক ও শাসিতের মধ্যে শান্তি স্থাপনের পক্ষে যথেষ্ট, তখন মনে হয় প্রতিবাদকে অপমান করা হইল। কারণ, যে আন্দোলন গড়িয়া উঠে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের উপর শ্বেতাঙ্গ পুলিশের অন্যায় গুলিচালনাকে কেন্দ্র করিয়া, বা এক বিদ্বেষী মানুষের রাষ্ট্রপতি পদে অভিষেক লইয়া (সম্প্রতি আমেরিকায় যে বিষয়গুলি লইয়া প্রতিবাদ সংগঠিত হইয়াছে, বিজ্ঞাপনটিতে এমন কিছু মিছিলের দৃশ্য-অনুকরণও রহিয়াছে), তাহাকে তো একটি পণ্য উপহার দিয়া মীমাংসার পথে লইয়া যাওয়া যায় না। তাহার সমাধানের পথ দীর্ঘ, বহু স্তর, বিপদসংকুল ও সংঘাতময়।
তবে কি প্রতিবাদ লইয়া কোনও লঘু মন্তব্য কখনও করা যাইবে না? প্রতিবাদকে সতত পূজা করিতে হইবে? তাহা নহে। প্রতিবাদকে ব্যঙ্গ করা যাইবে, ‘কিং ইন নিউ ইয়র্ক’ ছবির শুরুতে যেমন চার্লি চ্যাপলিন লিখিয়া দেন, ‘আধুনিক জীবনের অন্যতম গৌণ বিরক্তিকর ঘটনা হইল বিপ্লব।’ কিন্তু এইখানে বিপ্লবকে লইয়া রসিকতা করা হইতেছে (ছবিটিতে বিপ্লবের সমর্থনে বক্তব্য পেশ করা হয়)। কেহ চাহিলে বিদ্রোহকে নিচু করিয়াও দেখাইতে পারেন। কিন্তু বিক্ষোভকে মহান করিয়াও দেখাইব, আবার তাহাকে তরলীকৃতও করিব, এই দ্বিচারিতা করিলে মুশকিল। কেহ যদি বলে, ইদানীং যত বিদ্রোহ হইতেছে, সকলই সারহীন, তবে সেই কথারও প্রতিবাদ হইবে, কিন্তু সেই তর্কের ভার থাকিবে, কারণ ইহা দুই বিপরীত মতের লড়াই। কিন্তু কেহ যদি বলে অহো কেমন সুন্দর প্রতিবাদ হইতেছে রাস্তায় রাস্তায়, এই সময়ে উৎকৃষ্ট পানীয় থাকিলেই দ্রোহ সার্থক হইয়া যাইত, তখন বুঝিতে হইবে, প্রতিরোধকে উচ্চ স্থান দিবার ছলে তাহাকে পাওনা তাৎপর্য, গুরুত্ব হইতে বঞ্চিত করা হইল। এই ওপরভাসা ফাঁপা অগভীর চিন্তাধরনটিকে আক্রমণই শ্রেয়। এবং সেই আক্রমণ ঠান্ডা পানীয় খাওয়াইলেই প্রশমিত হইবে, এমন আশা করা অন্যায়।
যৎকিঞ্চিৎ
আর তো প্রেম করার প্রশ্ন উঠছে না, কারণ হেঁদু ব্রিগেড হুমকি দিচ্ছে ‘আমাদের সংস্কৃতিতে হাত ধরাধরি চলে না, ছেলেমেয়ে ঘনিষ্ঠতা চলে না।’ তবে চলে কী? দলবদ্ধ হয়ে অপছন্দের মানুষকে বেধড়ক ধোলাই। সুন্দর সংস্কৃতি। অগত্যা সন্ধেবেলা বাড়ির গর্তে ঢুকে আইপিএল দর্শন ও চিকেন রোল ভক্ষণ। অবশ্য ‘আমাদের’ সংস্কৃতিতে তো চিকেনও চলে না, আমিষ টোটাল বারণ। কিন্তু ঢ্যাঁড়সের রোল-এর কারবার বাগিয়ে খাঁটি হেঁদু কারবারি কি প্রফিট ফলাতে পারবে? ব্যাদে কী বলে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy