Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Ishwar Chandra Vidyasagar

বিদ্যাসাগরের অন্তরালে ঈশ্বরচন্দ্র

বিদ্যাসাগরীয় পরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু আত্মসচেতনই ছিলেন না, তাকে মান্যতা দিয়েই জীবনের উপান্তে এসে আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (১৮৯১)। ঈশ্বরচন্দ্র মূলত সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনের দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগর হয়েছিলেন। লিখছেন স্বপনকুমার মণ্ডল মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধুকে নিয়ে যে সকল চিঠি লিখেছিলেন তা শুধু মুগ্ধতাই বয়ে আনে না, বহুরূপী ঈশ্বরচন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হওয়ার পাশাপাশি ‘করুণাসাগর’ হওয়ার হদিস মেলে। তবে আম বাঙালির ‘দয়ার সাগর’ বিশেষণে সুবাসিত হলেও তা বিদ্যাসাগরের মতো তা বিশেষ্য হতে পারেনি। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৪:২৯
Share: Save:

প্রাতিষ্ঠানিক উপাধি কী ভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর জায়গায় ‘শর্ম্মা’ বা ‘শর্ম্মণঃ’ লিখতেন। তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি শুধু তাঁর কৌলিক উপাধিই শুধু নয়, নামটিকে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধুকে নিয়ে যে সকল চিঠি লিখেছিলেন তা শুধু মুগ্ধতাই বয়ে আনে না, বহুরূপী ঈশ্বরচন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হওয়ার পাশাপাশি ‘করুণাসাগর’ হওয়ার হদিস মেলে। তবে আম বাঙালির ‘দয়ার সাগর’ বিশেষণে সুবাসিত হলেও তা বিদ্যাসাগরের মতো তা বিশেষ্য হতে পারেনি।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’র (১৮৬৬) দু’টি সনেট ঈশ্বরচন্দ্রকে নিয়ে লেখা। প্রথমটিতে (‘বঙ্গদেশে এক মান্য বন্ধুর উপলক্ষে’) যাও-বা উহ্য ছিল, পরেরটিতে (‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’) তা শিরোনামে প্রকট হয়ে উঠেছে। মধু কবির মূল্যায়নেই ঈশ্বরচন্দ্রের বহুমুখী পরিচয়ের নিদান বর্তমান। ‘সমকালের সেরা ব্যক্তি’, ‘শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘প্রাচীন মুনিঋষির মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান’, ‘ইংরেজের মননশক্তি ও বাঙালি নারীর হৃদয়ের সমন্বয়’ প্রভৃতির মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রের বহুধা ব্যাপ্ত ব্যক্তিত্বের পরিচয় উঠে এলেও সবগুলিই সমুদ্রগামী নদীর মতো বিদ্যাসাগরে মিলিত হয়েছে।

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বীরশালিঙ্গম পান্তলু ‘সোসাইটি ফর সোশ্যাল রিফর্ম’ গড়ে তুলে তেলুগুভাষী অঞ্চলে বিধবা বিবাহের জন্য আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর’ বলে অভিহিত করা হয়। সে দিক থেকেও ঈশ্বরচন্দ্রকে পিছনে ফেলে বিদ্যাসাগরের খ্যাতি প্রশস্ত হয়ে ওঠে।

তাঁর বিদ্যাসাগরীয় পরিচয় সম্পর্কে ঈশ্বরচন্দ্র শুধু আত্মসচেতনই ছিলেন না, তাকে মান্যতা দিয়েই জীবনের উপান্তে এসে আত্মজীবনী শুরু করেছিলেন ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ (১৮৯১)। তার সূচনাবাক্যে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, ‘শকাব্দঃ ১৭৪২, ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, বীরসিংহগ্রামে আমার জন্ম হয়।’ অবশ্য তখনও বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়নি। তার জন্য ১৯ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৮৩৯-এ সংস্কৃত কলেজে পড়ার সময় হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষায় সাফল্যের মাধ্যমে তাঁর বিদ্যাসাগরে নবজন্ম লাভ হয়।

অন্য দিকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্রের মৃত্যুর পরে ‘বিদ্যাসাগর চরিত’ নামেই যে দু’টি প্রবন্ধ লিখেছেন, তাতেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরে বিলীন হয়ে পড়েন। অবশ্য সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্রের চরিত্রের মধ্যে দয়া ও বিদ্যার পরিবর্তে ‘অজেয় পৌরুষ’ ও ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’কে প্রধান গৌরব বলে অভিহিত করেছেন।

ঈশ্বরচন্দ্র মূলত সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনের অসামান্য দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের প্রশংসা পত্র পেয়েছিলেন। সংস্কৃত কলেজ থেকে পাশ করার অব্যবহিত পরিসরে মাত্র একুশ বছর বয়সে যখন তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনার জীবন শুরু করেন, তখনও তাঁর ভাল করে ইংরেজি শেখাই হয়নি। বন্ধুবর আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি ইংরেজি শিখেছিলেন। সংস্কৃতে তাঁর অসামান্য অধিকার যেমন তাঁকে শাস্ত্রীয় পরিসরে বিধবাবিবাহ থেকে বাল্যবিবাহ বা বহুবিবাহের আয়ুধ সংগ্রহে সাহায্য করেছিল, তেমনই ভাল ভাবে ইংরেজি জানার দৌলতে শিক্ষাবিস্তারের পথ সুগম হয়ে উঠেছিল। অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র অঙ্কও শিখতে চেয়েছিলেন। পরে অবশ্য তিনি সেই চেষ্টা থামিয়ে দেন। তাহলে বলা যেতে পারে, জ্ঞানী হিসাবে তাঁর পরিসর সুবিস্তৃত হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর জ্ঞানের চেয়ে কাণ্ডজ্ঞানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, শিক্ষাবিস্তার থেকে সমাজসংস্কার সবেতেই সেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় বর্তমান।

বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে (১৮৫৬) সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাফল্য তাঁকে যে বিপুল জনপ্রিয়তা প্রদান করে, তাতে তাঁর বিদ্যাসাগরীয় পরিচয় আরও তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে। ঈশ্বরচন্দ্র বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের জন্য সর্ব ভারতীয় পরিচিতি লাভ করেন। উনিশ শতকে তাঁকে নিয়ে গান বাঁধা হয়েছিল। শান্তিপুরের তাঁতিদের কাপড়ে বিদ্যাসাগর নাম উঠে এসেছে। একপলক দেখার জন্য উদ্গ্রীব জনতা রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থেকেছে। অথচ তাঁকে দেখে নিরাশ হয়েছে। দৃষ্টিনন্দনযোগ্য চেহারা তাঁর ছিল না।

আসলে মূর্তিকে প্রতিমা গড়ে তোলাতে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন বিমুখ। এ জন্য রেলি ব্রাদার্সের একখানি কাপড়কে ফেঁড়ে একখণ্ড পরতেন আর একখণ্ড গায়ে দিতেন। পায়ে থাকত দেশি মুচির শুঁড়তোলা চটিজুতো। শুধু তাই নয়, তাঁর সামনের চুল অবাঙালিসুলভ ছাঁটা।

রামমোহন রায় ১৮২৯-এ সতীদাহ প্রথা রদ করে যে সংস্কারের সূচনা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র তার পরিসমাপ্তির দায়ভার নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন। সতীদাহ রোধে জীবন বাঁচলেও মনে আর মানে বাঁচা দায় হয়ে উঠেছিল বিধবাদের। সে ক্ষেত্রে, ঈশ্বরচন্দ্র বিধবা বিবাহ প্রবর্তনে সেই বিধবাদের চোখের জল মোচনেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তাঁদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বহুবিবাহ রোধ থেকে বাল্যবিবাহের প্রতিরোধেও শামিল হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, নারীশিক্ষার বিস্তারের মাধ্যমে মেয়েদের স্বনির্ভর করে তোলা ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

ঈশ্বরচন্দ্রের লক্ষ্যেই ছিল দেশের মানুষের সার্বিক প্রগতি। স্বেচ্ছায় পারিবারিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্রমশ আত্মীয়পরিজনহীন নিঃসঙ্গতার মধ্যেও আজীবন জনবিচ্ছিন্ন হননি। মানসিক আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে তিক্ততাবোধে তাঁর জীবনের সেরা কাজ বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের জন্য একবার সখেদে বিরূপ মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন মাত্র, কিন্তু তা থেকে সরে থাকেননি। স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতা দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঈশ্বরচন্দ্রের সুহৃদ ছিলেন। বারবার প্রতারিত হওয়ার পরে সেই পরম সুহৃদকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’

বলা বাহুল্য, ঈশ্বরচন্দ্র সেই নিঃসঙ্গ জীবনের অন্তিম পর্যায়ে কলকাতা ছেড়ে সুদূর কার্মাটাড়ে গিয়েও তাঁর স্বধর্মে সক্রিয় থেকেছেন। তাঁর প্রত্যাশাহীন দানধ্যান নিয়ে উপকার করলে অপকার পাওয়ার কিংবদন্তী ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ সেই ‘অসার ও অপদার্থ’ লোকজনের প্রতি তার পরেও অবিচল ভাবে সক্রিয় থেকেছে তাঁর সাহায্যের হাত। অন্য দিকে, ঈশ্বরচন্দ্র জানতেন সাগরের জলের মতোই বিরূপ সমালোচনাও স্বাভাবিক, কিন্ত সেটাই সব নয়। তা পানের অযোগ্য হলেও তাই আবার বাষ্পায়িত হয়ে পানীয় জলের উৎস হয়ে ওঠে, দাহিত হয়ে লবণ নিষ্কাশন করে। তিনি যে যথার্থই বিদ্যাসাগর। সে দিক থেকে বিদ্যাশিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষিতের অবিকল্প প্রতিভূ, তা তাঁর বিদ্যাসাগরেই প্রতীয়মান।

লেখক শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE