Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মুখোমুখি

স্মরণে রাখা ভাল, এই প্রশংসা কেবল পর্যটনের নিরিখে প্রাপ্য এবং ইহাতে উদ্বাহু না হওয়াই বিধেয়। সংরক্ষিত দ্বীপপুঞ্জে ‘অনিয়ন্ত্রিত’ ভ্রমণ প্যান্ডোরার ঝাঁপি খুলিয়া দিতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

মুখ খুলিল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। গত অগস্টে উনত্রিশটি দ্বীপ হইতে ভিনদেশীদের জন্য রেস্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট (সংক্ষেপে র‌্যাপ) প্রত্যাহৃত হইয়াছে, অর্থাৎ সংরক্ষিত অঞ্চলগুলিতে ভ্রমণ করিবার জন্য আর বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন নাই। এবং অভিবাসন স্থল অর্থাৎ ভারতে প্রবেশ-প্রস্থানের বিন্দু হিসাবে যোগ্যতা অর্জন করিয়াছে দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। অতএব, বিদেশি পর্যটকরা ভারতের মূল ভূখণ্ড স্পর্শ না করিয়া সরাসরি দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করিতে পারিবেন। গত বৎসরের অক্টোবর অবধি হিসাব বলিতেছে, প্রায় বারো হাজার বিদেশি পর্যটক দ্বীপপুঞ্জে গিয়াছিলেন, ২০১৭-য় সংখ্যাটি ছিল পনেরো হাজারের কিছু অধিক। ভ্রমণের প্রক্রিয়াটি সহজতর হইলে ভ্রমণার্থী বাড়িবে। অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হইবে দ্বীপপুঞ্জ তথা অধিবাসীরা। বহু অনুসারী ক্ষুদ্র শিল্প সম্ভাবনার জন্ম হইবে। গ্রিসের সান্তোরিনি কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপ দীর্ঘ কাল ধরিয়া এতাদৃশ পন্থায় সমৃদ্ধ হইয়াছে। সুতরাং, সাধুবাদযোগ্য পদক্ষেপ।

স্মরণে রাখা ভাল, এই প্রশংসা কেবল পর্যটনের নিরিখে প্রাপ্য এবং ইহাতে উদ্বাহু না হওয়াই বিধেয়। সংরক্ষিত দ্বীপপুঞ্জে ‘অনিয়ন্ত্রিত’ ভ্রমণ প্যান্ডোরার ঝাঁপি খুলিয়া দিতে পারে। বিশেষত, ভারতের চিরাচরিত অভিজ্ঞতা: পর্যটকের সংখ্যা বাড়িলে অনিবার্য রূপে পরিবেশের সহিত সংঘাত উপস্থিত হয়। উচ্ছৃঙ্খল পর্যটক কানুনের বেড়ি মানেন না, দ্রষ্টব্যের ক্ষতি করিতে সর্বদা তৎপর থাকেন। জঙ্গলে পৌঁছাইয়া সমগ্র জীবকুলকে উত্ত্যক্ত করিয়া তুলিতে তাঁহারা বিশেষ পটু। পর্যটন ও পরিবেশের মুখোমুখি সংঘাতে দ্বীপপুঞ্জের তমসাটি গাঢ়তর। কারণ এই স্থলে পরিবেশের অংশ কেবল উদ্ভিদ, প্রাণী বা প্রাকৃতিক নিসর্গ নহে, দ্বীপগুলিতে বসবাসকারী বিশেষরূপে বিপদগ্রস্ত জনজাতি বা ‘পার্টিকুলারলি ভালনারেবল ট্রাইবাল গ্রুপ’-এর মানুষেরাও। ১৯৫৬ সালে এক বিশেষ আইনবলে তাঁহাদের সুরক্ষাদানের ব্যবস্থা হইয়াছিল। পর্যটন-ব্যবসা বাড়িলে অর্থলিপ্সার কবলে পড়িবে জনজাতিরা। ‘বিশ্বসাথে যোগ’-এর পরিবর্তে এই তাবৎকাল স্বাধীন জীবনযাপনকারীদের বিলুপ্তির পথে ঠেলিয়া দেওয়া হইবে। সংঘাতের আশঙ্কা অমূলক নহে— প্রমাণ করিয়া সেন্টিনেল জনজাতির হাতে প্রাণ দিয়াছেন পর্যটক অ্যালেন চাও।

বস্তুত, পরিবেশ রক্ষা কিংবা পর্যটকদের আতিশয্য নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত নহে। আড়াই বৎসর পূর্বে প্রখ্যাত ক্রিকেটার রবীন্দ্র জাডেজা গির অরণ্যে সিংহের সহিত নিজস্বী তুলিয়া বিতর্ক বাধাইয়াছিলেন। গঙ্গা নদীর পরিচ্ছন্নতা এবং পুনরুজ্জীবনের নিমিত্ত গৃহীত প্রকল্প ‘নমামি গঙ্গে’-তে বিস্তর অর্থব্যয়ের পরিকল্পনা হইলেও কাজ হইয়াছে সামান্য। অরণ্যের অধিকারে মানুষ হইতে শিল্প ও প্রযুক্তির পাল্লা ভারী হইয়াছে— একাধিক রাজ্যে উন্নয়নের স্বার্থে জঙ্গল হ্রাসের ছবিটি বর্তমানে পরিচিত। চার বৎসরে পরিবেশ সংক্রান্ত প্রশাসনিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাইয়াছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিও তাই অ-সম্ভব রহিয়া গিয়াছে। বহু পরিবেশকর্মী ও গবেষক তাই দ্বীপপুঞ্জ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তটিকে হঠকারিতা বলিয়াছেন। অতএব, পর্যটন ও পরিবেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কঠিন শর্ত। সেই শর্ত ভারতীয় সরকার মাথায় রাখিতেছে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE