Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

রোজগারের হাতিয়ার হোক পিঁপড়ের ডিম

পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোলে অনাহার-মৃত্যু সেই সময়ে সংবাদ শিরোনামে। তখনই বঙ্গদেশে প্রকাশ্যে এল একটি শব্দ— ‘কুরকুট’। কী এই ‘কুরকুট’। কী তার উপযোগিতা? কেনই বা জঙ্গলমহলে এত জনপ্রিয় এই ‘কুরকুট’। জানাচ্ছেন প্রণব হাজরাকী এই ‘কুরকুট’? এই ধরনের পিঁপড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Oecophylla sp। সাঁওতাল ভাষায় এই পিঁপড়েকে ‘হাও’ বা ‘হাউ’ বলে।

হাটে বিক্রি হচ্ছে ‘কুরকুট’। নিজস্ব চিত্র

হাটে বিক্রি হচ্ছে ‘কুরকুট’। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০৫:৩২
Share: Save:

মাওবাদী সক্রিয়তায় জঙ্গলমহল তখন উত্তপ্ত। পশ্চিম মেদিনীপুরের আমলাশোলের অনাহার-মৃত্যু সেই সময় সংবাদ শিরোনামে। তখনই বঙ্গদেশে প্রকাশ্যে এল একটি শব্দ— ‘কুরকুট’। এই ‘কুরকুট’ হল এক ধরনের পিঁপড়ের ডিম। তা খেয়েই নাকি জীবনযাপন করেন পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর তথা জঙ্গলমহলের মানুষ! সত্যিই কি তাই? নাকি অনাহার, অর্ধাহারের এক আরোপিত ছবি সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে এই ‘কুরকুট’ শব্দের গায়ে!

কী এই ‘কুরকুট’? এই ধরনের পিঁপড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Oecophylla sp। সাঁওতাল ভাষায় এই পিঁপড়েকে ‘হাও’ বা ‘হাউ’ বলে। দুমকা এলাকায় বলা হয় ‘হাঁও’। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, অবিভক্ত মেদিনীপুর এবং পুরো ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার জঙ্গলে এই হালকা কমলা রঙের পিঁপড়ের দেখা যায়। এরা স্বভাবে খুব দ্রুত এবং সতর্ক। কেউ বিরক্ত করলে আক্রমণকারীকে পাল্টা ধাওয়া করতে জানে। মূলত বড় বড় গাছে বসবাস করে। অতি ক্ষিপ্ততার সঙ্গে গাছে গাছে যাওয়া-আসা করতে পারে। মুহূর্তে উঠে যেতে পারে গাছের মগডালে। সাধারণত, গাছের মগডালের কয়েকটি পাতা সেলাই করে তৈরি করে বাসা। সেখানেই পাড়ে ডিম অর্থাৎ ‘কুরকুট’।

এই প্রজাতির পিঁপড়েদের ‘উইভার অ্যান্ট’ও বলা হয়। উঁচু গাছের মগডালে পিঁপড়ের লার্ভা-নিঃসৃত এক প্রকার ‘সিল্ক’ (‌‌রেশম) দিয়ে তিন-চারটে পাতাকে মুড়ে, সেলাই করে একটা থলির মতো বানিয়ে নেয় এরা। এই থলি যেমন মজবুত, তেমন দেখতেও সুন্দর। ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এই বাসার মধ্যেই রেখে দেয় পিঁপড়ের দল। পাকা ফলও এদের খাবার। এ ছাড়া, উইপোকা এবং অন্য কীটপতঙ্গ থেকেও খাবার হিসেবে রস সংগ্রহ করে ‘ইকোফাইলা’রা। এদের দলে রয়েছে শ্রমবিভাজন। বাসা তৈরি করা, খাদ্য সংগ্রহ করা, লার্ভা এবং রানির দেখাশোনা করা ইত্যাদি কাজ করে শ্রমিক ‘ইকোফাইলা’রা। তেমনই আক্রমণে সিদ্ধহস্ত সৈনিক ‘ইকোফাইলা’। এরাও খাদ্য সংগ্রহ এবং বাসা বিস্তারের কাজ করে থাকে। শ্রমিক এবং সৈনিক পিঁপড়েরা কমলা রঙের হয়। সৈনিকেরা আকারে একটু বড়। রানি পিঁপড়ে সাধারণত বাসার মধ্যেই থাকে। দেখতে সবজে-বাদামি।

শীত ও বর্ষার শুরুর দিকে গাছের মগডালে তৈরি বাসায় সাদা চালের মতো অসংখ্য ডিম পাড়ে এই পিঁপড়েরা। এই ডিম তথা ‘কুরকুট’ স্বাদে অত্যন্ত টক। এই ‘কুরকুট’-এর চাটনি অত্যন্ত জনপ্রিয় পুরুলিয়া-বাঁকুড়ায়। এই চাটনি তৈরিরও নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। চার চা চামচ ‘কুরকুট’, কাঁচা লঙ্কা, পুদিনা পাতা, অল্প পিঁয়াজ কিংবা রসুন মিহি করে বেটে কাঁচা সরিষার তেল, প্রয়োজন মতো নুন মিশিয়ে এই চাটনি তৈরি করা হয়। মিশ্রণটি এক চতুর্থাংশ নিয়ে শালপাতায় মুড়ে আগুনে পুড়িয়েও খাওয়া যায়। যে যার নিজের রুচি মতো খান। তবে অনেকেরই অভিমত, শালপাতায় মুড়ে পুড়িয়ে যে মিশ্রণটি তৈরি হয়, তা-ই নাকি বেশি সুস্বাদু। আবার সামান্য সরষের সঙ্গে ‘কুরকুট’ শিলে বেটেও খান অনেকে। অরণ্যের সন্তানদের কাছে ‘কুরকুট’ একটি উপাদেয় খাদ্যোপাদান।

‘কুরকুট’-এর ওষধি গুণও রয়েছে। এতে ‘ভিটামিন সি’ থাকে। সঙ্গে থাকে ক্যালসিয়াম। যা সাধারণ সর্দি, কাশি, এবং শিশুদের হুপিং কাশিতে খুবই কাজে দেয়। শবর জনগোষ্ঠীর মানুষদের বিশ্বাস, শীতকালে নিয়মিত ‘কুরকুট’-এর ঝোল খেলে অনায়াসেই শীতের মোকাবিলা করা যায়। প্রকৃতির কোলে বাস করা এই অরণ্যের সন্তানেরা প্রকৃতি থেকেই তাঁদের বাঁচার সব উপকরণ তথা রসদ সংগ্রহ করে নেন। এগুলি ‘ট্রাইবাল মেডিসিন’। আয়ুর্বেদিক তো বটেই, অনেক অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের প্রাথমিক উপাদান সংগৃহীত হয় এই অরণ্য থেকে। অরণ্যবাসী আমজনতা বনে বনে ঘুরে এই সম্পদ সংগ্রহ করে। হাটে হাটে তা বিক্রি হয়।

‘কুরকুট’-এর বাণিজ্যিক মূল্যও কোনও অংশে কম নয়। শীতকালে জঙ্গলমহলের প্রায় প্রতিটি হাটেই ‘কুরকুট’ বিক্রি হয়। আবার গ্রামে গ্রামে ফেরি করেও বিক্রি করেন অনেকে। তাঁদের কাছ থেকে প্রিয় খাদ্যবস্তু কিনে নেন স্থানীয়েরা। কারণ, তাঁদের কাছে চাল, ডাল, আনাজের সঙ্গে ‘কুরকুটে’র বিশেষ ফারাক নেই।

‘কুরকুট’ বহুবিধ উদ্দেশ্যসাধক একটি বনজ সম্পদ। মূল খাবারের সঙ্গে চাটনি, ভেষজ ওষুধ এবং মাছের খাদ্য—তিন রকম ভাবেই একে কাজে লাগানো যায়। তাই এর অর্থকরী দিকটিও কিন্তু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শোনা যায়, চোরা পথে দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলের এই বনজ সম্পদটি বাংলাদেশেও চলে যায়। সেখানে বা এ রাজ্যে জঙ্গলমহলের বাইরের জেলাগুলিতে এই ‘কুরকুট’ মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। মাছ ধরার সময় টোপ হিসেবেও কাজে লাগে। স্থানীয় ভাবে হাটে বা গ্রামে গ্রামে যে ‘কুরকুট’ বিক্রি হয়, তার দাম কেজি প্রতি ২০০-৩০০ টাকা। কিন্তু ফড়েরা এখান থেকে কিনে দুর্গাপুর, আসানসোল, বারাসত, দমদম প্রভৃতি জায়গার আড়তে মজুত করে। সেখানে ‘কুরকুট’ বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৬০০ টাকার মধ্যে।

এখন জঙ্গলমহল চায়, ‘কুরকুট’-এর অর্থকরী দিক ভেবে দেখুক সরকার। জঙ্গলমহলের ভূমিপুত্র এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী মনোরঞ্জন মাহাতোর মতে, এটি সংগ্রহে বিনিয়োগের কোনও প্রশ্ন নেই, জঙ্গল ধ্বংস করারও প্রয়োজন নেই। অথচ, বহু প্রকার উদ্দেশ্যসাধক ও গুণসম্পন্ন এই বনজ সম্পদটি নিয়ে ইতিবাচক প্রচার ও বাণিজ্যিক বাজার তৈরির ব্যাপারে সরকারের নজর নেই। তা হলে জঙ্গলমহলে রোজগারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে ‘কুরকুট’।

লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jangal Mahal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE