জানুয়ারি ২০১৫: মধ্যরাতে থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বিখ্যাত বাচিক শিল্পী-দম্পতি পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের বাড়িতে আক্রমণ হল। সারা বাড়ির কাচ ভাঙল, জানালা ফুঁড়ে প্রমাণ আকারের থান ইট এসে পড়ল বিছানায়, খুনের হুমকি হল, চেষ্টা হল শারীরিক নিগ্রহের। কারণ, শিল্পী-দম্পতি মধ্যরাত পেরিয়ে চলা লাউডস্পিকারের তাণ্ডব বন্ধ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সে অনুরোধে কর্ণপাত না করলে নিকটবর্তী দমদম থানায় অভিযোগ করেন। কয়েকদিন সংবাদমাধ্যমে হইহই হল, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষ-দম্পতির বাড়িতে ফোন করলেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা সরকারের মুণ্ডপাত করলেন এবং শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। চাপে পড়ে থানা কয়েকজনকে গ্রেফতার করল বটে, কিন্তু এখন থানার আধিকারিকরা ঘটনাটা প্রায় মনেই করতে পারেন না! কিন্তু এটা মনে করতে পারেন যে, অভিযুক্তরা বহু আগেই জামিন পেয়ে গেছে।
এপ্রিল ২০১৫: রাজ্য নির্বাচন কমিশন বিশ্ব বোকা দিবসে যাবতীয় ছাত্রকুলকে বোকা বানিয়ে মহামান্য হাইকোর্ট ও রাজ্য পরিবেশ দফতরের দু’দশক ধরে চলা পরীক্ষা সময়কালীন লাউডস্পিকার ব্যবহারের নির্দেশ উলটে দিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এতদিন নিয়ম ছিল যে, দেশের যে-কোনও বোর্ড বা কাউন্সিলের অধীন হওয়া সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে থেকে পরীক্ষার শেষ অবধি উন্মুক্ত স্থানে মাইক বাজানো চলবে না। প্রায় সাত বার হাইকোর্টে বহাল থাকা এই নির্দেশকে কলমের এক খোঁচায় পালটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার নির্দেশ দিলেন যে, যদিও ‘সি বি এস ই’ পরীক্ষা চলছে, তবুও পুরসভা নির্বাচনের প্রচার করতে প্রার্থীরা এমনি দিন-দুপুর তিনটে থেকে দশটা ও ছুটির দিন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে প্রচার করতে পারবেন। কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের যুক্তি, যাবতীয় রাজনৈতিক দল নাকি প্রবল ভাবে তার কাছে পরীক্ষার সময় মাইক ব্যবহারের জন্য দরবার করছিল, এবং এটা তাদের অধিকার! নির্দেশ-পরবর্তী কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্বস্তির উদ্গার দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, নির্বাচন কমিশনকে মাইক ব্যবহারের সমর্থনে রাজনৈতিক মহা-মহাজোটের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
তিন মাসের তফাতে হওয়া উপরের দুটি ঘটনা আলাদা হলেও, সত্যিটা হল, দু’টির মধ্যে প্রবল যোগাযোগ। বস্তুত দ্বিতীয়টির মতো ঘটনা আছে বলেই মধ্যরাতের দুষ্কৃতীরা প্রথমটি করতে সাহস পায়। তারা স্পষ্ট বোঝে যে, সমাজে সংখ্যালঘু হলেও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তারা সংখ্যাগুরু, কেননা অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের কাছে তাঁদের প্রয়োজনই অধিক। তাই প্রবল চাপে নিয়মরক্ষার্থে কয়েকদিনের জন্য গ্রেফতার হলেও, তাদের নিঃশব্দে জামিন হয়ে যায় খবরের কাগজের হেডলাইন পালটালেই। কোনও রাজনৈতিক দল রা কাটে না। বরং সমাজের যে অংশ বল্গাহীন নিয়মভাঙা শব্দতাণ্ডবের বিরুদ্ধে প্রথমবার সোচ্চার হন, তারা পরের বার জানালা বন্ধ করে, কানে তুলো লাগিয়ে শব্দব্রহ্মের দাপট ভোগ করেন।