Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

কংগ্রেসও বুঝেছিল, কেন্দ্রীয় শাসন দৃঢ়তর করা প্রয়োজন

বিজেপি শিবির স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত, কারণ তাদের রাজনৈতিক জীবনের পথচলা ৩৭০ ধারা বিলুপ্তিকরণের প্রতিজ্ঞা নিয়েই শুরু হয়েছিল। লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়গত বছর জুনে শ্রীনগরের দন্ত চিকিৎসক হিনা সফি ভাট বলেছিলেন, শুধু শ্রীনগর জেলাতেই ২০১৭-১৮ সালে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ বিজেপির সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৯ ০০:০৭
Share: Save:

গত কয়েক দিনে কাশ্মীর ও সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাঙালির তর্কচর্চার ক্ষেত্রটিতে অকস্মাৎ হাজির হয়েছে। এমনিতে গড়পড়তা বাঙালির সঙ্গে কাশ্মীরের পরিচয় তিনটি মাধ্যমে ঘটে— রাজা দেবপালের কাশ্মীর অভিযান, মফস্সল শহরের কাশ্মীরি শাল বিক্রেতা এবং জীবদ্দশায় অন্তত এক বার ভূস্বর্গে বেড়াতে যাওয়া। শেষ মাধ্যমটির অবস্থা এখন স্থিতিশীল নয়।

গোটা কাশ্মীরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিশালতা এবং ততোধিক ব্যাপ্তির ভারতীয় সংবিধানের জটিল অনুচ্ছেদগুলির মাঝে বিচরণের ধৈর্য সামাজিক মাধ্যম-নির্ভর এই ব্যস্ত যুগে আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি, যার সুযোগে রাজ্য রাজনীতি আজ ত্রিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিজেপি শিবির স্বাভাবিক ভাবেই উল্লসিত, কারণ তাদের রাজনৈতিক জীবনের পথচলা ৩৭০ ধারা বিলুপ্তিকরণের প্রতিজ্ঞা নিয়েই শুরু হয়েছিল।

বামপন্থীরা চিরকালের মতো এ বারও প্রবল জাতীয়তাবাদী স্রোতের বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। রাজ্যের বারো ঘর বামপন্থী হাঁড়ি এমনকি ‘অচ্ছুৎ’ পিডিএস-কেও এক উঠোনের তলায় আনার গুরুদায়িত্ব সিপিএম নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। সৈফুদ্দিন চৌধুরী বেঁচে থাকলে শাহ বানু বিতর্কের মতোই ৩৭০ ধারার বিষয়েও সিপিএমকে সমর্থন করতেন কি না, তাঁর অতি বড় সমর্থকও সন্দিহান হতে পারেন। গেরুয়া ঝড়ে বিধ্বস্ত তৃণমূল প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শ ছাড়া মুখ খুলতে নারাজ। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী আসল সত্যটা যেন বলেও বলছেন না।

একটি বিষয়ে এ দেশের বহু মানুষ সহমত পোষণ করেন যে কাশ্মীর ভারতের ‘অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ’। জাতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বামপন্থী তত্ত্বের লাগাতার প্রচার যাদবপুর বা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন রুম থেকে বেরোতে পারেনি। হিমালয়ের অন্য উপত্যকাগুলোর মতোই মহাঋষি কাশ্যপের নামেই কাশ্মীর উপত্যকার নামকরণ হয়েছে বলে এ দেশের বহু মানুষ বিশ্বাস করেছেন। আড়াই হাজার বছর আগে কম্বৌজ মহাজনদের মানুষ রজৌরি সেক্টরে তাঁদের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। শৈব ও বৌদ্ধ দর্শনচর্চার পীঠস্থান হিসেবে কাশ্মীর চিরকালই ভারতীয় ইতিহাসের পাতায় তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। পরবর্তী কালে ইসলামের আগমন ও উদার সুফিবাদের প্রভাবে এখানে জনবিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে এবং রাজ্যটি ক্রমে-ক্রমে মুসলিমপ্রধান হয়ে পড়ে।

১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিংহ এক প্রকার বাধ্য হয়েই ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক কাঠামোয় যোগ দেন। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া প্রয়োজন— ১৯৪৭ সালে যে ফর্ম পূরণ করে প্রবেশ-সংলেখ স্বাক্ষর করে অপরাপর দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে বা পাকিস্তানে যোগ দেয়, কাশ্মীরের মহারাজাকেও সেই একই ফর্ম স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। ফলে যোগদানের আইনগত ভিত্তি একই রকম ছিল। এই কারণেই ১৯৫৬ সালের পর থেকে রাজ্যটি এ দেশের সমস্ত রাজ্যের সঙ্গেই ঘোষিত ভাবে একই শ্রেণিভুক্ত হয়েছে। কংগ্রেসই জম্মু ও কাশ্মীরকে সাংবিধানিক ভাবে একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেছে।

কিন্তু বিপরীত দিকে কংগ্রেস ভারতের সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে কাশ্মীর রাজ্যটিকে বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করার অধিকারও দিয়েছিল। পৃথক ভাবে সংবিধান রচনা, পতাকা উত্তোলন ও শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে কিছু স্বতন্ত্র অধিকার রাজ্যটিকে দেওয়া হয়েছিল। চাহিদা, আঞ্চলিক সমস্যা পূরণ এবং বৈষম্য দূর করতে নাগাল্যান্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, অসম প্রভৃতি রাজ্যকেও বিশেষ সুবিধা দানের ব্যবস্থা হয়েছিল। ৩৭১ ও ৩৭১ (‌জে) অনুচ্ছেদ বলে দেওয়া ওই বিশেষ অধিকার অনেক ক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকার ধীরে-ধীরে কেড়েও নিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে তার প্রয়োজনও ফুরিয়ে এসেছিল।

আসলে কংগ্রেস তার দীর্ঘ দিন শাসনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছিল যে পরমাণু শক্তিধর দুই বৈরী রাষ্ট্রের মধ্যবর্তী কাশ্মীরে সামরিক কৌশলগত কারণেই কেন্দ্রীয় শাসন ও নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করা প্রয়োজন। এই কারণেই তারা ধীরে ধীরে রাজ্যটির বিশেষ সুবিধাগুলি চার দশক ধরে নীরবে কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীয় শাসনের বাঁধন শক্তিশালী করেছিল। ৩৭০ ধারা হিসেবে যা টিকে আছে, তার কঙ্কাল অপসারণের কাজটি কিন্তু কংগ্রেস নেতারা করে উঠতে পারেননি। কংগ্রেসের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ বিজেপি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। এতে তো দোষের কোনও কারণ দেখি না! পিডিপি বা ন্যাশনাল কনফারেন্সের মতো মুসলিম-প্রধান দলগুলো এক দিকে ‘পাকিস্তান জুজু’ দেখিয়ে, অপর দিকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে কংগ্রেস ও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ, উভয়ের সঙ্গেই প্রতারণা করে আসছিল ।

এই ক্ষেত্রে বিজেপি তার জন্মলগ্ন থেকেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘বলিদান’কে হাতিয়ার করে হিন্দুপ্রধান জম্মু ও বৌদ্ধপ্রধান লাদাখে সংগঠন রচনায় মনোনিবেশ করে। কাশ্মীরের কার্গিল-সহ বেশ কয়েকটি শিয়া অধ্যুষিত জেলাতেও জাতীয়তাবাদী আবেগ ও অনুন্নয়নের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন বিজেপিকে কাশ্মীরে শক্তিশালী করতে শুরু করে।

গত বছর জুনে শ্রীনগরের দন্ত চিকিৎসক হিনা সফি ভাট বলেছিলেন, শুধু শ্রীনগর জেলাতেই ২০১৭-১৮ সালে প্রায় তিন লক্ষ মানুষ বিজেপির সদস্যপদ গ্রহণ করেছেন। দিল্লিতে পড়াশোনা করতে এসে হিনা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ছাত্র সংগঠনের জাতীয়তাবাদী ভাবনায় আকৃষ্ট হন এবং গত বিধানসভা নির্বাচনে কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

এই বিশেষ পরিস্থিতিতে বিজেপি বিপুল পরিমাণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনরায় কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের ছ’টি আসনের মধ্যে তিনটিতে জয়লাভের পাশাপাশি শ্রীনগর আসনেও বিজেপি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এত বড় সাফল্যের পরে তারা যে কংগ্রেসের মতো দুর্বলচিত্ততা দেখাবে না, বরং গোটা দেশে জাতীয়তাবাদী আবেগকে ধরে রাখতে কাজে লাগাবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?

প্রদেশ কার্যকরী সদস্য, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE