Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

ড্রয়িংরুমে বসে লেখা কাব্যে ধরা পড়ে না ডুয়ার্সের বসন্ত

বসন্তউন্মাদ হতে গেলে যেতেই হবে উত্তরবঙ্গে জঙ্গলে, যেখানে এখন ঘন সবুজের মধ্যে জ্বলছে ফাল্গুনের দাবানল। লিখছেন অমিতকুমার দেবসন্তউন্মাদ হতে গেলে যেতেই হবে উত্তরবঙ্গে জঙ্গলে, যেখানে এখন ঘন সবুজের মধ্যে জ্বলছে ফাল্গুনের দাবানল। লিখছেন অমিতকুমার দে

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:০৪
Share: Save:

ভালবাসা জঙ্গলে গিয়েছে’ বইটি আমায় দেওয়ার আগে লিখে দিয়েছিলেন— ‘ভালবাসা ধূপগুড়িতেও গেল’! এই তীব্র বসন্তে আমি সেই ভালবাসা কী ভীষণ ভাবে টের পাই! একজন কবি কত গভীরে কিছু কিছু জনপদ আর তার ঋতুগুলোকে নিতে পারেন, বেণু দত্তরায়কে না পড়লে তা ঠিক ভাবে উপলব্ধি করা প্রায় দুরূহই। ডুয়ার্সের জঙ্গলে এখন বসন্ত ঝেঁপে এসেছে। ড্রয়িংরুমে বসে কবিতা নির্মাণে এ বসন্তকে ধরা যাবে না কিছুতেই।

বসন্তে মোরাঘাট অরণ্যে ঝরাপাতা আর কচিপাতার বৈপরীত্য দেখতে দেখতে কত বার ডুবেছি বেণু দত্তরায়ের কবিতায়। বাজনা নদীর পাশে বসন্তের দাবানল জ্বলতে দেখে কত বার মনে হয়েছে, ভালবাসা জঙ্গলেই গিয়েছে! তাঁর ‘নজরদারি’তেই দেখেছি— ‘বক্সা পাহাড়ের মাদারগাছের ডালে/রাতে ময়াল সাপ কেমন চাঁদনি চেটে খায়/আর ঠান্ডা নিথর চাঁদ/মগ ডালে ঝুলে থেকে সেই মজা দ্যাখে।’ কাঁঠালগুড়ি বাগানের কেরকেট্টা সাঁওতাল বেণু দত্তরায়কে বলেছিলেন— সব গল্পই আসলে পাহাড়ে-বনে-জঙ্গলে থাকে/সেখান থেকেই আসে/একটা আঁকশি দিয়ে তাদের ধরতে হয়! বেণু দত্তরায় দেখেছিলেন, ছোট করে ছাঁটা চুলের খালি-গা মানুষটা শেষ শীতের সকালে আঁকশি হাতে বনের দিকে যাচ্ছিল। এই ছোট্ট কবিতার ইঙ্গিত যে কত রূপান্তর ঘটাতে পারে কারও ভিতর, তা টের পাই নিজের মধ্যে। বসন্তে দু’চাকায় বেরিয়ে পড়ি জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। অদৃশ্য আঁকশি হাতে। সঙ্গে থাকেন ডুয়ার্সের বেণু দত্তরায়। মোরাঘাট, কোদালবস্তি, গরুমারা, জলদাপাড়ার জঙ্গলে অজস্র ঝরাপাতার মধ্যে শুয়ে বসে বাতাস ঝিঁঝিঁ আর পাখির শব্দ শুনতে শুনতে কচিপাতার জেগে ওঠা দেখা— সেই তো বসন্তযাপন! যে পারে এমন বসন্তদিনে ডুয়ার্সের বনের এই সন্ন্যাসীরূপকে শরীরে-মনে মেখে নিতে, সেই বসন্তসন্ন্যাসী হয়।

এমন বসন্তে আমার সঙ্গী বেণু দত্তরায়ের এক অসামান্য গদ্যের বই ‘কাল রাতে পলাশ ফুটেছে’। গদ্যে কী ভাবে চিরন্তন কবিতা লেখা যায়, এ বই না পড়লে বুঝে ওঠা যায় না— ‘কাল রাতে আমি আবার জঙ্গলে গেলাম। সেই অন্ধকার শাল শিরীষের বন। আজ ঠান্ডার দাপট যেন আরও বেশি। ঝিঁঝিঁর কলতানও যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বাংলোর দরজায় তালা ঝুলিয়ে, রাইফেল কাঁধে, হাতে বিশাল টর্চ, নীলবাহাদুরকে পিছনে পিছনে নিয়ে আমি সেই জঙ্গলে এসে অবশেষে টর্চ জ্বালিয়ে পলাশফুলগুলিকে দেখলাম। আজ দুপুরে, বিকেলেও একবার এসে দেখে গিয়েছি, কালো কালো কুঁড়ি ভরা গাছগুলো তেমনি স্থির! অথচ এরই মধ্যে, সময়ের এই ফাঁকটুকুর মধ্যে, দুরন্ত শীতের হাওয়া তুচ্ছ করে পলাশের ফুটে ওঠা আমাকে প্রায় পাগল করে দেয়। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ফুটেছে! আমার অন্তর্গত উন্মাদনা ওরই মধ্যে প্রকাশ পেল।’

যে সত্যিকারের বসন্তউন্মাদ হতে চায়, তাকে বনেই যেতে হবে। এ সময় কত সব বিচিত্র গন্ধ বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। সে সব জানা-অজানা গন্ধের ভেতর মিশে থাকে অন্তহীন মনখারাপ, পাগলাটেপনা, অদ্ভুত বিষাদ, অনেক পাওয়ার পরেও কী ভীষণ না পাওয়ার কষ্ট, কাউকে দেখার-ছোঁয়ার উদ্‌গ্রীব আকুলতা। বসন্ত আসলে এমনই হয়। কোনও সংজ্ঞায় বাঁধা যায় না। জয়ন্তীর শুকিয়ে যাওয়া নদী তার বালু-পাথর, রুক্ষ পাহাড় আর জঙ্গল নিয়ে যে ভাবে ফাল্গুন-চৈত্রে পড়ে থাকে, তা বুক হু-হু করায়। গয়েরকাটা চা-বাগানের গভীরে সূর্যাস্তের পর মোরাঘাট অরণ্য থেকে যখন একের পর এক ময়ূর ডেকে ওঠে, অন্ধকার জমতে থাকে চা-পাতায়, কী শূন্যতা যে নেমে আসে, তা বসন্তপ্রেমিক মাত্রেই জানেন!

বেণু দত্তরায় ‘চৈত্রে, চৈত্রদুপুরে’ শীর্ষক লেখায় এমনই তীব্র বসন্তের কথা লিখেছেন— ‘রাশি রাশি শুকনো পাতা তখন ঝরে যাচ্ছে। চৈত্রে রেললাইন পেরিয়ে গরম নদীর পুল, সাপটানা নদীর হাওয়ার উজানে, ডিমা নদীর ব্রিজ, গয়েরকাটা-চামূরচিবাজার-চৈতিঝোরা সাঁকো সেতু ডিঙিয়ে, শাল আর গামবাড়ির অরণ্যে, সাঁতালি বস্তিতে কিংবা টোটোপাড়ায়, ভেটাপট্টি বা বানারহাটে এখন সমস্ত দুপুরই প্রকৃতি জুড়ে যেন নীলামের ঘন্টি বাজে,শুধু পাতা ঝরানোর খেলা। নিঃস্ব পাতা ঝরানো এখন আফালচাঁদের বনে, শুকনা ফরেস্টে, খুটিমারি-নীলপাড়া কিংবা ডায়না রেঞ্জে, বক্সা ডিভিশনের রাজাভাতখাওয়া আর জৈন্তীতে কান পেতে শুনলে গুণীনের গুপীযন্ত্রের মতো অদৃশ্য তান। ঝরানো পাতা ছুটে যাচ্ছে কাঁঠালগুড়ি বাগানে, কাঠামবাড়ির বনে, শাল আর শিরীষের সবুজ বীথিকায়, ডামডিমে ওদলাবাড়িতে... কোথায় নয়।... ভুটানঘাটের ডাকবাংলোর ধারে কখন ফুটেছে অদৃশ্য চাঁপা, নাগরাকাটা বাজারের মধ্যেও চকিত কাঞ্চনফুলের রক্তদীপ্তি। অনার্য কন্যার আয়ত ঈষৎ ঘোরঘোর দেখে সন্দেহ, সময়টা মধুমাস কি না। এরই মধ্যে মাদল বেজেছে রাঙামাটি চা-বাগানে, জুড়ন্তির পাহাড়গুলিতেও।... শালফুলের মিঠে মিঠে সুবাস রামসাই অরণ্যের রয়াল বেঙ্গল বাঘের ঘুম ভাঙিয়ে জানিয়েছে, সূর্য এখন উজ্জ্বল হলুদ, বোগেনভেলিয়ার পাতাদের রঙ লাল, স্বাধীন পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।’ তাই বেণু দত্তরায়ের মনে হয়— নদীজলে, ঝোরায়, ঝিলে, জঙ্গলে, পাহাড়ে, বাংলা জুড়েই এখন বসন্ত।

মন্দার, অশোক, শিমূল আর পলাশ বসন্তে কী ভালবাসায় জুটি বাঁধে। কখনও পাশাপাশি, কখনও আলাদা আলাদা। সব পাতা ঝরিয়ে এক অমোঘ নিরাসক্তির পাশেই কী তীব্র লালের চরমতম আসক্তি! বিস্ময় লাগে! গাছের নীচে রক্তদাগ। মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে বাথানের মোষের দল, ধুলো উড়ছে চার দিকে। আকাশ মেঘলা হয়ে ঝড়ের অপেক্ষায় থম মেরে আছে চতুর্দিক। সব উড়িয়ে দেওয়া বাতাস উন্মাদের মতো ঘুরতে থাকে। সজনেফুল টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। অনেক ফলের সম্ভাবনা চুকিয়ে আমের মুকুলঅসহায় পড়ে যায়। তার মধ্যেই মনকেমনের মতো জেগে ওঠে ছোটবেলা।

বসন্তের ডান হাতে হাত রেখে পড়তে থাকি বেণু দত্তরায়ের গদ্য— ‘কাল রাতে পলাশ ফুটেছে। আজ সকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই হ্যাটকোট চাপিয়ে ওভারকোট গায়ে সোজা চলে গেলাম বনের ধারে। শিশিরের ফোঁটাগুলি টপটপ করে ঝরছিল। রক্তিম প্রাণের মঞ্জুরী জ্বালিয়ে দেখলাম পলাশগুচ্ছ। আরও বেলা হতে সেই রং মেখে নিলাম প্রাণের মধ্যে। তারপর বাংলোয় ফিরে ব্রেকফাস্ট সমাধা করেই দৌড় মারলাম অফিসে। কাজগুলো চটপট শেষ করে ফেলতে পারলেই গাড়ি নিয়ে একবার ছুট লাগাব। পিচ বাঁধানো রাস্তার ধারে এরই মধ্যে নিশ্চয় আরও পলাশ ফুটে উঠেছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাপিয়ে যে পলাশ শুধু যৌবনেরই ঘুম ভাঙায় না, আরক্তও করে তোলে। কেননা, পলাশ যে খুনি যৌবনেরও রং, বেদনাবরন অগ্নিশিখায় দাউদাউ করে জ্বলে!’

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

spring North bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE