দিলীপ ঘোষ মহাশয়কে অভিনন্দন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য রাজনীতির মূলধারায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন। নরেন্দ্র মোদীর জনসভার দিন বিজেপি কর্মীদের পুলিশ-প্রহারকে তিনি শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থন জানান নাই, বলিয়া দিয়াছেন, (পুলিশ নিজেকে না শুধরাইলে) ভবিষ্যতেও এমনটাই ঘটিবে। ইহাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি। ইহাই বঙ্গ-রাজনীতির ঐতিহ্য। কেবলমাত্র অনুব্রত মণ্ডল নহেন, গণতন্ত্রের শিষ্টতাকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিবার দোষে অনেকেই দুষ্ট, অথবা কৃতিত্বে অনেকেই কৃতী। বিরোধী রাজনীতি কখনও শিষ্টতার গণ্ডি ছাড়াইবে না, কখনও আইন লঙ্ঘন করিয়া হিংস্র হইয়া উঠিবে না, এমন নীতি মানিয়া চলিলে গত শতকের মধ্য ভাগে তাঁহাদের কোনও আন্দোলনই দাঁড়াইত কি না, কথাটি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের হতমান নেতৃবর্গ ভাবিয়া দেখিতে পারেন। অবকাশ পাইলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভাবিতে পারেন, ‘ছোট ছেলেদের ছোট ভুল’ বা ‘তাজা ছেলে’-র ‘দুষ্টামি’ বা ‘মাথায় অক্সিজেন কম পৌঁছানো’ নেতার পুলিশকে বোমা মারিবার হুমকিগুলিকে নিঃসংশয় প্রশ্রয় দেওয়াই কি তাঁহার রাজনীতির অভিজ্ঞান নহে? কালীঘাট হইতে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইয়া মুরলীধর সেন লেন, রাজ্যের রাজনীতিতে রং একাধিক, কিন্তু তাহার চলনগতি অবিকল। দিলীপ ঘোষ, পরে অবতীর্ণ হইয়াও, নিশ্চয় দেখিয়া শিখিয়াছেন। তিনি বুঝিয়া লইয়াছেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যদি গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিতে হয়, তবে ইহাই পথ। কথাটি পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কতখানি লজ্জার, ভাবিবার দায় তাঁহার নাই। বস্তুত, অর্ধ শতকেরও বেশি সময় ধরিয়া যে ঘটনা ঘটিয়াই চলিতেছে, তাহাতে আর লজ্জার কিছু অবশিষ্ট থাকে কি না, সেই কথাটিও ভাবিয়া দেখিবার।
পুলিশের গায়ে হাত তোলা পশ্চিমবঙ্গে কার্যত জলভাত হইয়াছে। কেন, তাহা খুঁজিতে বসিলে শাসকদের কথাই আসিবে। প্রশাসনের যে পৃথক অস্তিত্ব আছে, তাহা যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পরিবর্ধিত অংশ নহে, এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা ভুলিয়াছেন। অন্তত চার দশক আগেই। প্রশাসনও বিনা বাধায় বশ্যতা স্বীকার করিয়াছে। ক্ষমতাসীন নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হওয়াই চাকুরির শর্ত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। নতিস্বীকারের বাহুল্যে এমনই অবস্থা হইয়াছে যে কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রও থানায় ঢুকিয়া বড়বাবুর গায়ে হাত তুলিবার পূর্বে দুই বার ভাবে না। সেই তুলনায় তো দিলীপ ঘোষ বড় মাপের লোক। কে বলিতে পারে, পরশুর পরের দিন রাজ্যে তাঁহার গুরুত্ব হয়তো আরও চার আনা বাড়িবে। অতএব, পুলিশকে ধমকাইবার, হুমকি দেওয়ার অধিকার তাঁহার আছে, এমনটা তিনি ধরিয়া লইতেই পারেন। তাঁহার দলের কর্মীরাও জানিলেন, শুধু শাসক দলের কর্মীদের নহে, তাঁহাদেরও পুলিশ পিটাইবার হক জন্মাইয়াছে।
দিলীপ ঘোষের কথাগুলি অতি নিন্দনীয়। এই মনোভাবকে তীব্র ধিক্কার জানানো বিধেয়। কিন্তু, সেই নিন্দা করিবেন কে? সেই ধিক্কার কাহার গলায় শোনা যাইবে? আজ দিলীপবাবু যে দোষে দুষ্ট, সেই কলঙ্কের দাগ যে প্রতিটি দলের হাতেই। যাঁহারা এক কালে শ্রেণিশত্রুজ্ঞানে কনস্টেবলের দিকে বোমা ছুড়িতেন, তাঁহাদের কি দিলীপবাবুর অবস্থানের নিন্দা করিবার নৈতিক অধিকার থাকিতে পারে? পুলিশকে বোমা মারিবার ঢালাও পরামর্শ দেওয়া অনুব্রতকে যে নেত্রী সস্নেহে আড়াল করিয়া চলিয়াছেন, তিনি কি দিলীপবাবুর দিকে নৈতিকতার অঙ্গুলি নির্দেশ করিতে পারেন? পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অতীত ও বর্তমান সওদাগরদের এই প্রশ্নটি এড়াইবার কোনও উপায় নাই। অন্তত, শিক্ষাটি গ্রহণ করুন— নিজের দোষ স্বীকার করিবার সৎসাহস না থাকিলে অপরের নিন্দা করিবার আর উপায় থাকে না। তাহার পরও নিন্দা করিলে নির্লজ্জতা বড় প্রকট হইয়া উঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy