Advertisement
০৯ মে ২০২৪
সমাজ বিদায় নিয়েছে, রাষ্ট্র নীতি বানিয়েই ক্ষান্ত

তিনটে ছোট্ট মেয়েকে কেন বাঁচানো গেল না

এক সঙ্গে এতগুলো দুর্ভাগ্য সব বাচ্চার হয় না বটে, কিন্তু দুটো বা তিনটে কারণ বহু শিশুর জীবনেই ঘোর সত্যি। তা হলে, সেই বাচ্চাগুলোও কোনও এক দিন অনাহারে মরে যেতে পারে? অথবা, বেঁচে থাকলেও পুষ্টির অভাবে ক্রমে মুছে যেতে পারে তাদের যাবতীয় সম্ভাবনা? গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের কিচ্ছুটি করার থাকবে না, দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া?

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৮ ০০:২৩
Share: Save:

শুধু না খেতে পেয়ে তিন তিনটে মেয়ে মরে গেল? শিশুদের অনাহারে না রাখতে রাষ্ট্রের এত তোড়জোড়, এত উদ্যোগ সত্ত্বেও? ভেবে দেখলে, সাধারণ মানুষ, বিশেষত শিশুরা যাতে অনাহারে না থাকে, তার জন্য ব্যবস্থা নেহাত কম হয়নি সাত দশকের স্বাধীন দেশে। অঙ্গনওয়াড়ি আছে, মিড ডে মিল আছে, খাদ্য সুরক্ষা আইন আছে। তার পরও রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার লিঙ্ক না করানোয় ঝাড়খণ্ডের এগারো বছর বয়সি সন্তোষী কুমারীকে অনাহারে মরে যেতে হয়েছিল, সত্যি। কিন্তু সেটা যে ব্যতিক্রম— একশো শতাংশ আধার লিঙ্কের খেয়ালে মশগুল রাষ্ট্রযন্ত্রের সেই নৃশংস নিস্পৃহতার উদাহরণ যে সৌভাগ্যক্রমে নিয়ম হয়ে ওঠেনি— সে কথাও সমান ভাবে সত্যি।

দিল্লির তিন বোনের মৃত্যু বোধ হয় ততখানিও ব্যতিক্রম নয়। কেন মরেই যেতে হল আট, চার আর দুই বছরের বাচ্চা তিনটিকে, সেই কারণ সন্ধানে অনেকগুলো তথ্য উঠে আসছে। পরিবারটা হদ্দ গরিব। তাদের বাবা মাতাল, বাড়ি ফেরে না প্রায় দিনই। মা অপ্রকৃতিস্থ, আপাতত তার ঠাঁই হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। পুরনো ঠিকানা ছেড়ে তারা সদ্য উঠে এসেছিল নতুন আস্তানায়, যেখানকার অঙ্গনওয়াড়ির খাতায় তাদের নাম তুলিয়ে উঠতে পারেনি মা-বাবা। পরিবার-পরিজন কেউ কাছে থাকে না তাদের। বড় মেয়েটার স্কুলের খাতায় নাম ছিল, কিন্তু প্রায়শই যেত না স্কুলে, তাই মিড ডে মিলও খাওয়া হত না তার।

কারণগুলোর কোনওটাই ফেলনা নয়, মিথ্যে নয়। এবং, কোনওটাই বিরল নয়। এক সঙ্গে এতগুলো দুর্ভাগ্য সব বাচ্চার হয় না বটে, কিন্তু দুটো বা তিনটে কারণ বহু শিশুর জীবনেই ঘোর সত্যি। তা হলে, সেই বাচ্চাগুলোও কোনও এক দিন অনাহারে মরে যেতে পারে? অথবা, বেঁচে থাকলেও পুষ্টির অভাবে ক্রমে মুছে যেতে পারে তাদের যাবতীয় সম্ভাবনা? গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের কিচ্ছুটি করার থাকবে না, দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া?

এই প্রশ্নের আপাতত একটাই উত্তর হয়। ভারত যে ভঙ্গিতে তৈরি করেছে তার কল্যাণ নীতি এবং যে ভাবে সেই নীতি প্রয়োগ করে এসেছে, তাতে অন্য কোনও উপায় নেই। প্রশ্নটা দোষ দেওয়ার নয়। সত্যিই খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো সর্বজনীন কল্যাণ নীতি দুনিয়ার অনেক দেশেই নেই। আইসিডিএস-এ যে ব্যাপ্তিতে শিশুদের পুষ্টির ব্যবস্থা করা হয়, সেটা খুবই বিস্তৃত। সমস্যা অন্যত্র। ভারতে কল্যাণরাষ্ট্রের কাছে মানুষকে আসতে হয়। রাষ্ট্র তার প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি টপকে মানুষের কাছে যায় না। যাওয়ার নীতি নেই বলেই। অঙ্গনওয়াড়ির খাবার পেতে হলে আগে অভিভাবককে গিয়ে বাচ্চার নাম লিখিয়ে আসতে হয়। রেশনের চাল পাওয়ার জন্য আগে কার্ড তৈরি করতে যেতে হয়, তার পর লাইন দিতে হয় রেশন দোকানে। কার্ড থাকা সত্ত্বেও মাসের পর মাস কেউ রেশন না তুললে রাষ্ট্র খোঁজ করতে আসে না, কেন রেশন তুলছে না তারা? জানতে চায় না, খাবার না পেয়ে কষ্টে নেই তো পরিবারটা? ডিরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসে পড়ে থাকলেও রাষ্ট্র খোঁজ করে না, কেন টাকাটা তুলে খরচ করতে পারল না লোকটা? ব্যাঙ্কের নিয়মকানুন জানে না বলেই কি? ভারতের কল্যাণ নীতি প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দিয়েছে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান। গণবণ্টন ব্যবস্থা, আইসিডিএস। কিন্তু, কোনও শিশু সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছতে পারল কি না, তার সুফল নিতে পারল কি না, তা জানার দায় রাষ্ট্র নেয়নি।

এই না-জানার চোরাবালিতেই দিল্লির তিন বোনের মৃত্যু রচিত হল। যাদের বাবা দায়িত্বজ্ঞানহীন মাতাল, মা অপ্রকৃতিস্থ, তাদের রেশন কার্ড করিয়ে দেবে কে? কে নিয়ে যাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে, কে তুলে দেবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে এসে পড়ে থাকা ১৮০১ টাকা? কল্যাণরাষ্ট্রের চোখের সামনে অতএব মরে গেল তিন বোন। এই মৃত্যু প্রশ্নাতীত ভাবে কল্যাণরাষ্ট্রের ব্যর্থতা। কোনও অজুহাত ছাড়া স্বীকার করে নিতে হয়, দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, তার যাবতীয় প্রতিষ্ঠানসমেত, তিনটে বাচ্চা মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।

প্রতিষ্ঠান-সর্বস্ব কল্যাণ নীতিতে অমর্ত্য সেন আপত্তি করবেন ঠিক এখানেই। আপত্তিটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অর্থনীতি চর্চার সঙ্গে সঙ্গে ন্যায্যতার দর্শন নিয়ে তাঁর কাজ গোটা দুনিয়ায় স্বীকৃত। অমর্ত্য বলবেন, সব চেয়ে দরিদ্র মানুষের সব চেয়ে বেশি কল্যাণ করতে পারে, তেমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করাও যথেষ্ট নয়। শুধু প্রতিষ্ঠান তৈরি করেই তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা যায় না। মানুষ সেই প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছতে পারছে কি না, এবং তাদের আচরণ, অভ্যাস সেই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে পারার মতো কি না, তা জানতে হবে। সেগুলো যদি না হয়, তবে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেও সব চেয়ে পিছনের মানুষের জন্য ন্যায়ের ব্যবস্থা করা যাবে না।

অনেকখানি সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও বলে ফেলা যাক, এখানেই দার্শনিক জন রলস্-এর সঙ্গে তাঁর বিরোধ। রলস্-এর মত: সব চেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষের সব চেয়ে বেশি কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে যে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক নিয়ম, সেগুলো বেঁধে দিলেই যথেষ্ট। সেই নিয়ম মেনে চললেই নিশ্চিত হবে তাঁদের ন্যায়প্রাপ্তি। অমর্ত্য বলবেন, না। শুধু প্রতিষ্ঠান তৈরি করলেই হবে না, তার সুবিধাগুলো যে প্রান্তিকতম মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে, তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে তাদের ঘরের দোরগোড়া অবধি। খোঁজ নিতে হবে, পোলিয়োয় পা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কোন ছেলেটা স্কুলে গিয়ে তার মিড ডে মিলের অধিকার নিতে পারছে না, ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে নিখরচায় পড়ার সুযোগ। জানতে হবে, বাউন্ডুলে বাবা কোন মেয়েটার রেশন কার্ড বানিয়ে উঠতে পারেনি। কোন অনাথ শিশুকে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ নেই। তার পর, প্রতিটা ক্ষেত্রে, এই অসুবিধাগুলো দূর করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন, সব করতে হবে। তার জন্য যত টাকা খরচ করা প্রয়োজন, করতে হবে। পিছপা হওয়ার অধিকার কল্যাণরাষ্ট্রের নেই।

ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার সেই দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারেনি। কিন্তু, দায়িত্ব কি শুধু রাষ্ট্রেরই? সমাজের নয়? যে বস্তিতে বারো ঘর এক উঠোন, সেখানেও কোনও বাড়িতে দিনের পর দিন হাঁড়ি না চড়লে খোঁজ নেওয়ার দায়িত্ব কি পড়শির নেই? আইন নেই কোনও। পড়শির খোঁজ না করলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে না, জেল-হাজত হবে না। কিন্তু, সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানটারও তো কিছু অলঙ্ঘনীয় নিয়ম মেনেই চলার কথা। দরকার হলে স্বামীকে লুকিয়েও তো পড়শির অভুক্ত বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে দিতেন পাশের বাড়ির গিন্নিরা, কয়েক বছর আগেও। পাশের বাড়ির লোক খোঁজ নিতেন, দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী সংসার খরচের টাকা দিচ্ছে কি না বৌটাকে। প্রয়োজন হলে রেশন তুলে এনে দিতেন, বাচ্চাটাকে পৌঁছে দিতেন স্কুলে। একটু অন্য ভাবে বললে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আর মানুষের মধ্যের ফাঁকটুকু জুড়ে দিত সমাজ। জুড়ে দিতেন প্রত্যেকে, প্রত্যেকের জন্য। সমাজ নিজের জন্য তৈরি করে নেওয়া দায়িত্বটুকু পালন করত। দিল্লির বস্তি যদি এই কাজটুকু করতে পারত, কে জানে, মেয়ে তিনটে হয়তো এখনই মরত না।

কল্যাণরাষ্ট্র যত ক্ষণ না অবধি সত্যিই পৌঁছতে পারছে মানুষের দোরগোড়ায়, সমাজের এই যোগসূত্রটা একেবারে অপরিহার্য ছিল। কেন আমাদের সমাজ সমষ্টি থেকে ক্রমে ব্যক্তির হয়ে গেল, সেই কারণ নিশ্চয় অনেকে খুঁজছেন। কোনও একটা নির্দিষ্ট কারণ নয়, অনেকগুলো কারণের সন্ধানও হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু, প্রতিটা কারণই এক কথা বলবে— শুধু রাষ্ট্রই ব্যর্থ হয়নি, সমাজও হয়েছে। একশো ত্রিশ কোটির দেশ তিনটে মেয়েকে বাঁচাতে পারেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Death Starvation Delhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE