Advertisement
E-Paper

মাস্টারমশাই

মাস্টারমশায় সব্যসাচী ক্লাসে শেখাতেন কী ভাবে প্রশ্ন ফাঁদতে হয়, কী ভাবে সাজানো-গোছানো গৃহীত বক্তব্যের মাধ্যমেই সুলুকসন্ধান করে বুনটের আলগা গিঁটগুলি খোলা যেতে পারে। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার রবরবা, তপন রায়চৌধুরী আর ধর্মা কুমার-এর সম্পাদনায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্ডিয়াজ় ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি রিভিউ’-এর মতো পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছে।

গৌতম ভদ্র

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৬

আমার মাস্টারমশায় সব্যসাচী ভট্টাচার্য আমার মতো অসংখ্য ছাত্রের মাস্টারমশায়। ১৯৭০-এর দশকের পর নিদেনপক্ষে চার দশক জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত সব ছাত্রের ইতিহাসবিদ্যা চর্চা ও আধুনিক ভারতীয় ইতিহাসে সরাসরি গবেষণায় হাতেখড়ি তাঁর কাছেই হয়েছিল। অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের শিক্ষক জীবনের প্রথম পর্যায়ের ছাত্র আমি। গবেষণার প্রথমেই তিনি যে বক্তব্যটা আমাদের মতো নবীন ছাত্রদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন— কী প্রশ্ন করছি, কী ভাবে প্রশ্ন সাজাচ্ছি, সেটা ভাবাই ইতিহাস বিদ্যাচর্চার প্রাথমিক সোপান, ইতিহাসবিদের আত্মসচেতন হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। ইতিহাসবিদের জাত চেনা যায় অতীত বিষয় প্রসঙ্গে তাঁর নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্থাপনে, প্রশ্ন উত্থাপনের ভঙ্গিতে। বিদ্যার নিজস্ব অভ্যাসেই আর্কাইভস-এ গিয়ে জিজ্ঞাসু ইতিহাসবিদকে প্রমাণ হিসাবে দলিল উদ্ধৃত করতে হবে, ঢাউস গবেষণা গ্রন্থ লিখতে হবে। কিন্তু নিজের প্রশ্নের দিশা ঠিক না থাকলে যে কোনও গবেষকের বাঁশবনে ডোমকানা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

মাস্টারমশায় সব্যসাচী ক্লাসে শেখাতেন কী ভাবে প্রশ্ন ফাঁদতে হয়, কী ভাবে সাজানো-গোছানো গৃহীত বক্তব্যের মাধ্যমেই সুলুকসন্ধান করে বুনটের আলগা গিঁটগুলি খোলা যেতে পারে। নব্বইয়ের দশকে অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চার রবরবা, তপন রায়চৌধুরী আর ধর্মা কুমার-এর সম্পাদনায় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্ডিয়াজ় ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল হিস্ট্রি রিভিউ’-এর মতো পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়েছে। সেখানে অবশিল্পায়ন (ডিইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজ়েশন) নিয়ে মরিস ডি মরিস ও তপন রায়চৌধুরী, তরু মাৎসুই ও বিপান চন্দ্রের বিতর্ক জমে উঠেছিল, যা তখন ইতিহাসের সিলেবাসে অবশ্যপাঠ্য। জেএনইউ’তে সব্যসাচী ভট্টাচার্য অর্থনৈতিক ইতিহাস পড়াতেন, পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীতেও ছিলেন। অবশিল্পায়নের মতো বিতর্কের চৌহদ্দিতে মাস্টারমশায় কারিগরদের দক্ষতা শিক্ষণ অর্জন ও প্রক্রিয়ার সমস্যাকে তুলে ধরতেন। তাঁর মতে, অবশিল্পায়নের সমস্যায় কেবল কর্মসংস্থানের মাথাপিছু সংখ্যাতত্ত্ব বিচার, নিছক গড়পড়তা আয় বাড়া ও কমার হিসেবেই বিবেচ্য নয়। যে কোনও উন্নতি/উন্নয়নের ইতিবৃত্তে নানা প্রকৌশল বা হাতযন্ত্রে ছোটখাটো প্রায়োগিক কুশলতা উদ্ভাবনে ও আত্তীকরণে কারিগরদের উদ্যোগের সুযোগ কী ভাবে প্রসারিত হচ্ছে বা মার খাচ্ছে, সেই ইতিহাসের অনুপুঙ্খ ধরে সব্যসাচী বিভিন্ন কৌমগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা নির্ণয়ের কাহিনিতে প্রবেশ করার ধরতাই দিতেন। ঔপনিবেশিক সমাজে অর্থনৈতিক চাওয়াপাওয়া বা দুর্দশা-বঞ্চনার হিসেবনিকেশ কী ভাবে রাজনীতির তন্তুতে জড়িয়ে গিয়েছিল, কী করে অর্থনীতি অবশেষে হয়েছিল রাজনীতি, সেই বৃত্তান্ত তাঁর আলোচনায় পরিষ্কার ফুটে উঠত। রূপান্তরে তর্কটা যেন আজও চলছে। উনিশ শতক থেকে একুশ শতক, ঔপনিবেশিক ভারত থেকে গোলকায়িত ভারত, অম্লমধুর ভাষায় বঙ্কিমি ‘উন্নতি’র ধারণা থেকে মোদী-দিদির রংদার উন্নয়নের তত্ত্বে, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’— এ হেন আবহাওয়ায় আলোচনার ঘরানায় অনেক প্রতার্কিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু সবার দেওয়া স্বস্তি-বাক্যের বিপরীতে অস্বস্তির খোঁচা জেগে থাকে, মাপকাঠির নির্ণয়ে জীবন ও জীবিকা, দিনচর্যা ও সামাজিক প্রত্যাশার স্তরগুলির মধ্যে বিপর্যাস ঘটেছে কি না, ভাষায় এক বোঝাতে আর এক বোঝানো হচ্ছে কি না, এ হেন জিজ্ঞাসা উঠতে থাকে। একবিংশ শতকের যাপিত মননে গত শতকের সত্তরের দশকের পুরনো প্রশ্নগুলি অনুরণিত হয়, সব্যসাচী ভট্টচার্যের ইতিহাস পড়ানোর রেশটুকু আজও মনে রয়ে গিয়েছে।

সারা জীবন ধরে ইতিহাসবিদ সব্যসাচী ভট্টাচার্য অনেক লিখেছেন, প্রবন্ধ ও রচনা সঙ্কলন সম্পাদনা করেছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত নিজস্ব গবেষণার ও নানা ইতিহাসবিদের রচনা নিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির তিন খণ্ডে বঙ্গের ইতিহাস সম্পাদনার কাজ শেষ করে গিয়েছেন, প্রকাশিত হবে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে সব্যসাচী ভট্টাচার্যের জিজ্ঞাসু মন ঘুরে বেড়িয়েছে, অর্থনৈতিক ইতিহাস থেকে জাতীয়তাবাদী চিন্তার সমস্যা, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ বিচার থেকে গাঁধী-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক বিশ্লেষণ। প্রশ্ন তৈরি করা থেকে সমস্যা নির্ণয়ের ছক তৈরি করা আর সেই অনুযায়ী তথ্য নির্বাচন ও বিশ্লেষণের রকম ভাবা— এই অভিমুখ তাঁর সব রচনাতেই পাই। তবে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষায় লেখা ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে পুস্তিকাটি এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে দ্য ডিফাইনিং মোমেন্টস অব বেঙ্গল ১৯১৯-১৯৪৭ (২০১৪) নামের বইটি তাঁর রচনারীতির বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কোনও এক কেন্দ্রীয় প্রশ্ন থেকে সমস্যার জাল ছড়িয়ে পড়েছে, আর নানা তথ্যের সন্নিবেশে ও যুক্তির কুশলতায় সমস্যা নিরাকরণের চেষ্টা চলছে— এই দুই অক্ষে উপরোক্ত পুস্তক দু’টির এক একটি অধ্যায় লেখা হয়েছে। যেমন, বিশ শতকের স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলার একটি অধ্যায় লিঙ্গবিচারের সমস্যাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। অন্য পক্ষে আর একটি অধ্যায়ের প্রশ্ন ও সমস্যা ছিল বঙ্গভূমিতে গাঁধী-রাজনীতি ও ওই রাজনীতির নানা পরিবর্ত। একটি অধ্যায়ের বিষয়ের সঙ্গে আর একটি অধ্যায়ের বিষয়ের আপাত-মিল নেই। কিন্তু বিতর্কের কাঠামোয় বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সমাজ ও রাজনীতি চিন্তনের মনন ও প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বাংলার রাজনীতিকে কী কী গুণে অন্বিত করেছিল, তার চিত্র আছে। বহুচর্চিত বিষয়ের এই ধরনের ঐতিহাসিক উপস্থাপন আমাদের সচকিত করে।

মনে পড়ে যে আমার এম ফিল গবেষণাপত্রে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অভিলেখ্যাগার থেকে নানা দলিলের টানা লম্বা সব উদ্ধৃতি ছিল। অবেক্ষক সব্যসাচী নিজে আর্কাইভস-এ গিয়ে কয়েকটা দলিলের উদ্ধৃতি যাচাই করেছিলেন। আমার লেখা আদ্যন্ত সংশোধন করার সময় দেখিয়েছিলেন যে দলিলের একটানা লম্বা উদ্ধৃতিকে কী করে ভাঙা যায়। মাঝে মাঝে নিজস্ব মন্তব্য যোগ করে উদ্ধৃতিগুলোকে নানা অনুচ্ছেদে ছড়িয়ে দিতে হয়। ফলে মূল প্রশ্নের আলোকে দলিলের বক্তব্য স্পষ্টতর হয়, পড়তেও ভাল লাগে, অন্বেষকের ‘ফুট’ কাটা ও দলিলের ভাষার আলাপচারিতার মধ্যে বিশ্লেষণ জমে ওঠে। পরে বুঝেছি এই উপদেশের মধ্যে ইতিহাস-চেতনার একটি নিহিতার্থ ছিল। আর্কাইভের প্রকীর্ণ তথ্য ও ছোট ছোট ঘটনার তাৎপর্য আমার প্রশ্নের সূচিমুখে অন্বিত হয়ে অতীত-চিন্তায় ঝলসে ওঠে, গোষ্পদে অন্বেষকের বিশ্বদর্শন হয়, সেই দর্শনই ফিরে তার রচনায় উপস্থাপিত হয়। এক কথায় প্রশ্নবিচারেই ইতিহাসবিদের শেষ যাচাই হয়।

সব্যসাচী ভট্টাচার্য নানা প্রশাসনিক দায়িত্ব সামলেছিলেন— বিশ্বভারতীর উপাচার্য, ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিকাল রিসার্চ-এর অধ্যক্ষ বা সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস ক্যালকাটা নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। কর্মসুবাদে মাস্টারমশায়ের প্রশাসক রূপের সঙ্গে দু’এক বার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল, মতভেদও হয়, মনান্তর হয়নি। তাঁর ভাবা বঙ্গীয় ইতিহাস প্রকল্পে লেখার জন্য বার বার অনুরোধ করেছিলেন, পারিবারিক বিপর্যয়, আমার চিন্তায় অনচ্ছতা ও স্বভাবকুঁড়েমির জন্য আর লেখা দেওয়া হয়নি।

এই পর্যায়ে দুটো আলোচনাসভার কথা মনে আছে। দুটোতেই তিনি সভাপতি। আর তাঁর বুড়ো ছাত্র হিসেবে আমি বক্তা। একটি আঞ্চলিক ইতিহাসের আলোচনাসভা, স্থান: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। সেমিনারে আবদুল হালিম, শরর-এর ‘সরগুজ়িস্তা লখনউ’ ও সৈয়দ আহমেদ খান-এর ‘আসার-উস-সানাদিদ’ নিয়ে আমি আলোচনা করছিলাম, অধ্যায় ধরে, সরাসরি কোনও প্রাকল্পিক নির্দেশিকা দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিল না। হঠাৎ ‘স্যর’ বলে উঠলেন, ‘‘এই ভাবে ‘পড়ানো’ অনেক দিন আগে চালু ছিল, তাই না, তুমি দেখলুম এখনও ভোলোনি।’’ দ্বিতীয় সেমিনার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয়: আন্দোলন ও প্রতিরোধ চর্চার আধুনিক ধারা। সভাপতি আমার মাস্টারমশায়, আর বক্তা সেই ‘আমি’ বলে বুড়ো ছাত্রটা। সেমিনারটির এক সপ্তাহ আগেই ‘বইয়ের দেশ’-এ আমার মাঝারি ধরনের সাক্ষাৎকার বেরিয়েছে, মাস্টারমশায় পড়েছেন। আলোচনার শুরুতে সবাইকে শুনিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘বিনয় তোমার সহজ ‘গুণ’ নয়, স্ব-ধর্ম ছাড়ছ কেন?’’

নিজ গুণে নিজ ভাবে বড় হওয়া ও অন্যকে বড় হতে দেওয়াই তো শিক্ষার ও শিক্ষকের লক্ষ্য— এটাই সব্যসাচী ভট্টাচার্য মনে করতেন। দেখা হলে মাঝে মাঝে নতুন বইয়ের খবর জিজ্ঞাসা করে প্রশ্ন তুলতেন যে ‘নিজের কথা’ লেখক কী আর কতটুকু বলেছেন? পরম্পরা গ্রাহ্য, কিন্তু পরম্পরার মধ্যে নিজের জায়গা খুঁজে নিতে হবে, নিজের স্বরকে সুচিহ্নিত করতে হবে, চর্বিতচর্বণ তো ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধেয় শবে পরিণত করে।

ভারী ভারী গবেষণাগ্রন্থের সঙ্গে সঙ্গে সব্যসাচী ছোট ছোট পুস্তিকা লিখেছিলেন। যেমন ফ্ল্যাশব্যাকের ধরনে লেখা বন্দে মাতরম্ গীতির আলেখ্য ও কিশোরপাঠ্য গৌতম বুদ্ধ (বুদ্ধ ফর দ্য ইয়ং)। শেষোক্ত বইয়ের গোড়াতেই আড়াই হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া এক মানুষের চরিত্র বিচারের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলেছেন, ‘‘এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের প্রত্যেককে নিজের মতো করে খুঁজে নিতে হবে।’’ পুস্তিকার শেষে আনন্দের প্রতি বুদ্ধবচনেই বুদ্ধজীবনের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন, ‘অত্তদীপো বিহরথ আনন্দ, অত্ত শরণা ভব।’ আত্মদীপ হতে হবে, নিজেই হবে নিজের শরণ। এই বাচনিক চিন্তনে ও চর্চায় আমাদের মতো থাকবন্দি ও গুরুবাদী দেশে আধুনিকতা জারিত হয়। ওই বচনটি কারও মাথায় ঘুরঘুর করলে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বা হিন্দুত্ববাদ— কিছুই তাকে জোর করে গেলানো যাবে না, পোডিয়াম থেকে প্রাজ্ঞদের শত উপদেশ বাগাড়ম্বর বলে মনে হবে— তার অহং তো আত্মদীপ হতে চায়। যে কোনও স্বৈরতন্ত্রের কাছে আত্মদীপ মানুষটা মারাত্মক। শেষ পর্যন্ত মাস্টারমশায়কে জানাতে পারিনি যে ওই বুদ্ধবচনটা তাঁর এই বুড়ো ছাত্রেরও বড় পছন্দসই।

Sabyasachi Bhattacharya History Professor Jawaharlal Nehru University Author
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy