Advertisement
E-Paper

চিটি চিটি ব্যাঙ ব্যাঙ-এ থাকেন শান্তিনিকেতনের প্রফেসর শঙ্কু!

টিলার উপর বাড়িটির নাম চিটি চিটি ব্যাঙ ব্যাঙ। বাড়ি তো নয়, আস্ত একটা গবেষণাগার। স্টারলিং ইঞ্জিন, অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহার দেখতে অথবা ককাটেল পাখি, বেড়াল, হাঁস আর খড়িশের সহাবস্থানে চাঁদের আলোয় বেহালায় ইমনকল্যাণের সুরমুর্ছনায় ভেসে যেতে শান্তিনিকেতনের প্রফেসর শঙ্কুর বাড়ির জুড়ি মেলা ভার। লিখলেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক দীপঙ্কর রায়। এই বাড়িতে এখনও রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির আলো পৌঁছোয়নি। কিন্তু বাড়ির নানা অংশে আছে অচিরাচরিত শক্তির উৎস সূর্যের আলো থেকে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের সোলার প্যানেল। ডায়নামো ইঞ্জিন, যেটি পা দিয়ে পাম্প করে বা নৌকোর বৈঠার মতো দাঁড় টেনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৪
নিজের তৈরি সাইকেলে অরণি চক্রবর্তী। ছবি: লেখক

নিজের তৈরি সাইকেলে অরণি চক্রবর্তী। ছবি: লেখক

ইয়ান ফ্লিমিং-এর লেখা উপন্যাসের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ-আমেরিকান বাদ্যযন্ত্রের ফ্যান্টাসিতে একটি গাড়িকে নিয়ে চিটি চিটি ব্যাঙ ব্যাঙ সিনেমাটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। যে গাড়ির আপন সত্ত্বা আছে। যে প্রায়শই মালিকের কথা না শুনে নিজের মর্জিমাফিক চলতে ভালবাসে। যাঁরা এই গল্পটা জানেন তাঁদের কাছে প্রফেসর শঙ্কু নামে পরিচিত এক মুখ সাদা দাড়িওয়ালা মানুষটি। আর যাঁরা নেহাতই খাওয়া পরার মানুষ তাঁদের কাছে তিনি অরণি বুড়ো। শান্তিনিকেতনের গোয়ালপাড়ায় ছোট্ট টিলার উপর এক অদ্ভুত বাড়ির মালিক। যে বাড়ির নাম চিটি চিটি ব্যাঙ ব্যাঙ। বাড়ি এমনই যেখানে প্রবেশ করার কোনও দরজা নেই। আছে শুধু বড় বড় কয়েকটি জানালা। সারমেয়, মার্জার বাহিনী, পাখি ও নাগ পোষ্যদের নিয়ে থাকেন প্রফেসর শঙ্কু থুড়ি অরণি চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী শমিতাদি।

এই বাড়িতে এখনও রাজ্য বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানির আলো পৌঁছোয়নি। কিন্তু বাড়ির নানা অংশে আছে অচিরাচরিত শক্তির উৎস সূর্যের আলো থেকে বিকল্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের সোলার প্যানেল। ডায়নামো ইঞ্জিন, যেটি পা দিয়ে পাম্প করে বা নৌকোর বৈঠার মতো দাঁড় টেনে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। ওই অঞ্চলে মরে যেতে থাকা অ্যাকুইফারগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জিং প্ল্যান্ট আর তাতে জলের জোগান দিতে রেইনওয়াটার হারভেস্টিং-এর কজওয়ে, ফিল্টার পিট্ ও আরও কতরকমের চোখ ধাঁধানো ব্যবস্থা। আধুনিক শান্তিনিকেতনে এ এক আশ্চর্য সমীকরণ!

একই পল্লিতে যেখানে ধনী, অনাবাসীরা তাঁদের বাংলো বাড়িতে (যেখানে তাঁরা বছরে বার দুয়েকের বেশি আসেন না) কোরিয়ান কিংবা মেক্সিকান ঘাসের ‘লন’-এর শোভা বাড়ানোর জন্য সাবমার্সিবেল পাম্প বসিয়ে ভৌমজলের দফারফা করছেন সেখানেই অরণিদা, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে, কয়েক লাখ টাকা খরচ করে পল্লিবাসীদের জলের ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করছেন নিজের প্রচেষ্টায়।

বিশ্বভারতীর পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। আদতে সেটা তাঁর গৌণ পরিচয়। তাঁর কৃতিত্বের তালিকা বেজায় লম্বা। একাধারে তিনি শিক্ষক, আবিষ্কারক, পশুপ্রেমী (সোসাইটি ফর প্রিভেনশন অফ ক্রুয়েলটি ট্যু অ্যানিম্যালস্-এর সদস্য), হোমিওপ্যাথিক ডিরেক্টরির কম্পিউটার ডেটাবেসের জন্য প্রোগ্রাম-রচয়িতা, ফ্রি সফটওয়্যার লিন্যাক্স বিশেষজ্ঞ, লিন্যাক্স আন্দোলনের সমর্থক ও সক্রিয় কর্মী, স্টেরিলাইজেশন অফ স্ট্রীট-ডগস্ প্রোগ্রাম ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা, আধুনিকতম প্রযুক্তি প্রয়োগের দ্বারা নিজের ডিজাইনে নানা যন্ত্রপাতি নির্মাতা, সঙ্গীতজ্ঞ (বিশ্বভারতীর অধ্যাপকদের মিছিলের পুরোভাগে বেহালায় সুর তুলতে তুলতে অরণিদার আশ্রম-পরিক্রমা করার দৃশ্য কে ভুলতে পারে) এবং সর্বোপরি অতিশয় রসিক ও জনপ্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। আর শান্তিনিকেতনের পথেঘাটে অরণিদার নিজের হাতে বানানো, তাঁর একমাত্র বাহন রিকামবেন্ট বাইসাইকেল বা আবর্তিত সাইকেলটিও তাঁর মতোই জনপ্রিয়।

যে মানুষটি একদিন নববিবাহিতা স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, একটি বেড়ালছানার প্রাণ রক্ষার কারণে বাড়িওয়ালার সঙ্গে মতদ্বৈতে রাতারাতি ভাড়া-বাড়ি ছেড়ে এক টুকরো জমি কিনে শৌচালয় আর মাটির উনুন বানিয়ে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন তাঁর বাড়ির নাম চিটি চিটি ব্যাঙ ব্যাঙ হওয়া আশ্চর্যের নয়। কারণ অরণিদা ও তাঁর স্ত্রী বিশ্বাস করেন তাঁদের বাড়িও আপন খেয়ালে থাকতে ভালবাসে। সাদামাটা জীবন যাপন আর এলাকার মানুষকে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে সুস্থভাবে বাঁচার দিশা দেখানো এই মানুষটিই প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা খরচ করে রাস্তার কুকুরদের নির্বীর্যকরণের জন্যে একটি ল্যাপেরোস্কোপি ইউনিট চালু করেছেন।

শান্তিনিকেতনবাসী অরুণ নাগ কিংবা স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো দু-একজন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এই কাজে। তাঁর কাজের কথা শুনে প্রযুক্তিগতভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু অরণিদা একাই একশো।

বর্ণময়, শিক্ষার সারস্বত সাধনায় নিবেদিত প্রাণ ও বিকল্প জীবনধারার পথ প্রদর্শক অরণিদার জন্ম কলকাতার বালিগঞ্জে, ১৯৬০ সালের ১৫ জুলাই। বাবা অভয়কুমার চক্রবর্তী ও মা বেলা মুখোপাধ্যায় দুজনেই ছিলেন ভূগোল-বিশারদ। অরণিদার শিক্ষা ক্রমান্বয়ে ক্যালকাটা বয়েজ স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে ১৯৯৫ সালে পিএইচডি শেষ করে ১৯৯৭ সালে বিশ্বভারতীতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ছোটবেলা থেকেই যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করা অভ্যাস।

আর এ সব কাজে তাঁকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য ছিলেন তাঁর মেসোমশাই উষারঞ্জন ঘটক, কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের ডিরেক্টর। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই ঠিক করে ফেললেন যে বড় হয়ে বৈজ্ঞানিক হবেন। গবেষণাগারে নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন প্রফেসর শঙ্কুর মতো। কিন্তু গবেষণাগার বানাতে যে অনেক টাকা লাগে! মধ্যবিত্ত পরিবারে মানুষ অরণিদা। পাবেন কোথায় এত টাকা? অরণিদার কথায়, ‘‘মা তখন ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। মা-ই পরামর্শ দেন অধ্যাপক হওয়ার। অধ্যাপনা করলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ মিলবে বলে মা প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন বলে আজ এগুলো করতে পেরেছি।’’

এ দিকে, লেখাপড়ার সঙ্গেই বেহালা শেখা শুরু হয়েছিল। বেহালা শেখার ক্লাসে আলাপ হয়েছিল ভবিষ্যতের সহধর্মিনী ও জীবন সংগ্রামে সহযোদ্ধা শমিতাদির সঙ্গে। তিনিও অরণিদার মতো প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যা নিয়ে লেখাপড়া করে সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। কলেজে শিক্ষার্থীদের খুব প্রিয় ছিলেন কিন্তু মাথায় ঢুকেছিল বিজ্ঞানকে আরও বেশি করে জানতে হবে। তাই আট বছর চাকরি করার পর তিনি ছেড়ে দিলেন কলেজে শিক্ষকতা। শুরু হল নিজের গবেষণা। অরণিদার যাবতীয় উদ্ভাবনে শমিতাদি সেনাপতির ভূমিকা পালন করেন।

শিক্ষকদের নাম করতে গিয়ে এখনও আপ্লুত হন অরণিদা। যদিও নিজেকে শিক্ষক হিসেবে সফল বলে দাবি করেন না। তার দুটি ব্যাখাও খাড়া করেন নিজের মতো করে। প্রথমত, তিনি আজ পর্যন্ত পরবর্তী প্রজন্মকে কম্পিউটার পাইরেসি থেকে বিরত করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু সফল হননি। কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ইনস্টল করে এসেছেন যাতে করে মানুষ পাইরেটেড সফটওয়্যার ব্যবহার না করে। সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

দ্বিতীয়ত, মাংসের দোকানে পাঁঠার ছালটি অবিকৃত রাখার জন্য যে নিষ্ঠুর উপায়ে নিরীহ প্রাণীগুলিকে হত্যা করা হয় তার প্রতিবাদ করার জন্য সেইসব দোকান থেকে মাংস না কেনার সিদ্ধান্ত নিতে ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। নিজে নিরামিশাষী হয়েছেন কিন্তু একজনকেও তার মতাবলম্বী হিসেবে তৈরি করতে পারেননি। তাই হয়তো অরণিদা কর্মস্থলেও পদোন্নতির জন্যে আবেদনপত্র জমা দেননি আজও, কর্মজীবনের প্রান্তে এসেও।

এমন মানুষের দেখা আজও শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী আশ্রমেই পাওয়া যাবে। কবিগুরুর আশ্রমিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান সাধনার ঐতিহ্য অনেকটা এমনভাবেই মাত্র পাঁচজন ছাত্র ও শিক্ষক জগদানন্দ রায় এবং শিবধন বিদ্যার্ণব-এর হাত ধরে শুরু হয়েছিল।

যাঁর সম্পর্কে রথীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “সবচেয়ে ভাল লাগত যখন জগদানন্দ বিজ্ঞান পড়াতেন” আর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ ভাষণে বলেছিলেন, ‘‘ছাত্রদের কাছে সর্বতোভাবে আত্মদানে জগদানন্দের একটুও কৃপণতা ছিল না।’’ অরণিদার মত শিক্ষক ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে এলে, এস ওয়াজেদ আলির সঙ্গে সুর মিলিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে বলা যায়, ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।’

Professor Shonku Shantiniketan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy