Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দিকে দিকে রাজা ষোড়শ লুই

বোধ গড়ে তোলার বা গড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া যে এটা সামাজিক-রাজনৈতিক নির্মাণ, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে ও হবে। বাড়িতে ইস্কুলে মাঠে দফতরে নিজেকে কী ভাবে ‘আমি’ করে তুলতে হয়, বেচতে হয় ‘আমি’কে, তার শিক্ষা চলে নিরন্তর।

স্যমন্তক ঘোষ
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

বছর আটেকের আহীর ‘আমি’ বলতে পারে না। মধ্যম পুরুষ এবং প্রথম পুরুষের বোধ থাকলেও উত্তম পুরুষের ধারণা তৈরি হয়নি। এটুকু শুনেই বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জিগ্যেস করলেন, ‘‘ছেলেটি কি অটিস্টিক?’’— আহীর অটিস্টিক। চিকিৎসা চলছে। বিশেষজ্ঞ বোঝালেন, এ ধরনের মানুষদের অনেক সময়েই ‘আমি’র বোধ তৈরি হয় না। তবে চেষ্টা করলে সেই বোধ জাগিয়ে তোলা যায়।

বোধ গড়ে তোলার বা গড়ে ওঠার এই প্রক্রিয়া যে এটা সামাজিক-রাজনৈতিক নির্মাণ, তা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে ও হবে। বাড়িতে ইস্কুলে মাঠে দফতরে নিজেকে কী ভাবে ‘আমি’ করে তুলতে হয়, বেচতে হয় ‘আমি’কে, তার শিক্ষা চলে নিরন্তর।

— পুরনো সেই কথাগুলোই নতুন ভাষায় বলছিলেন ভদ্রলোক। চেক রিপাবলিকের প্রাগ সিটি সেন্টারের কাছে ফুটপাতে বসে ট্রাম্পেট আর অ্যাকর্ডিয়ান বাজান তিনি। গানও গান। স্থানীয় লোকে বলে ‘পাগলা বুড়ো’। আশি-পেরনো ভদ্রলোক বরফস্নাত রাস্তায় চমকে দিয়েছিলেন ‘কাতিয়ুশা’ শুনিয়ে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েট রাশিয়ায় তৈরি হয়েছিল এই ‘দেশাত্মবোধক’ গান। পাহাড়ি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে প্রেমিকা স্মরণ করছেন যুদ্ধে যাওয়া প্রেমিককে। বিশ্বাস করছেন, দেশের সম্মান রক্ষা করে প্রেমিক ফিরে আসবেন।

সংসার হবে। আর কখনও যুদ্ধে যেতে হবে না প্রিয়তমকে। পরবর্তী কালে অবশ্য প্রচলিত এই গানের নামেই রকেট লঞ্চার তৈরি করবে সোভিয়েট রেড আর্মি। কাতিয়ুশা হয়ে উঠবে ‘উগ্র দেশপ্রেম’-এর নামান্তর।

কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়ায় সৈন্য ছিলেন ‘পাগলা বুড়ো’। টগবগে দেশাত্মবোধ, মনে বিশ্বাস: কাঁধের বন্দুকেই রাষ্ট্রের সম্মান। ফলে তিনি আম আদমি নন। জলপাই পোশাককেই রাষ্ট্র বলে মনে হত সময় সময়। ‘‘এটাই সৈন্য বাহিনীর ট্রেনিং, বুঝলে! এ ভাবেই ক্ষমতার ধারণা গেঁথে দেওয়া হয় মগজে। এক বার ভাবনাটা মাথায় ঢুকে গেলে গুলি চালাতে হাত কাঁপে না।’’ কাটা কাটা বাক্যে গায়ে কাঁটা দেওয়া গল্প শোনাচ্ছিলেন তিনি। হাতে অ্যাকর্ডিয়ান। সেই তিনিই ক্ষমতাচ্যুত হলেন ভেলভেট বিপ্লবের আগে। ট্রেনিংয়ে পা ভাঙল। চিকিৎসক জানিয়ে দিলেন ডান পা বাদ দিতে হবে। উর্দি হারালেন। বুঝলেন, লহমায় মোর আমি ডুবে যায় নেমে।

একটা ক্ষমতা হারালে মানুষ অন্য ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে। সৈন্য গেলেন চার্চে। সেখানেই অ্যাকর্ডিয়ান চর্চা। কিন্তু মন টিকল না। বুঝলেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও ‘আমি’-সর্বস্বতায় জর্জরিত।

সেই থেকে তাঁর মন্ত্র: রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। অ্যাকর্ডিয়ান আর ট্রাম্পেট নিয়ে ফুটপাতে। বহু পরিশ্রমে অভ্যেস করেছেন বাক্যে একটিও ‘আমি’ না বলার। প্রয়োজনে আহীরের মতোই প্রথম পুরুষে নিজেকে চেনান। ‘আমি’র ব্যবহার তাঁর কাছে কেবলই ক্ষমতার প্রকাশ।

— ফরাসি রাজা ষোড়শ লুই ‘আমিই রাষ্ট্র’ বলে ইতিহাসে বড় বেশি নিন্দিত। কিন্তু দেশে দেশে ছড়িয়ে থাকা তাঁর উত্তরসূরিরা কী বলছেন? রাজাবাবু যে কথা এক বার বলেছিলেন, আরও আরও চড়া স্বরে সে কথাই কি বলছেন না ট্রাম্প-মোদী-মমতা?

প্রতি দিন ‘আমি’কেই তো সরকার বলে ঘোষণা করছেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী! বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শত সমস্যা, হাজার বাধা সত্ত্বেও, আম আদমিকে ‘তিনি’ই পাইয়ে দিচ্ছেন পরশপাথর। কারণ, তিনিই রাষ্ট্র। তিনি যা ভাল বলে মনে করেন সেটাই একমাত্র ভাল।

আর তাঁর যা পছন্দ নয়, তাকে তো রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে দাগিয়ে দেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি যা বললেন, যে শব্দে ও ভাষায় ‘দেশ’ উচ্চারণ করলেন, তাতে স্পষ্ট, তিনিই নিজেকে রাষ্ট্র! ভোট প্রচারে তাঁর দলও প্রধানমন্ত্রীকেই রাষ্ট্র বলে চিনিয়ে দেয়।

দেশে দেশে প্রতি মুহূর্তে রাজনীতিকরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা লার্জার দ্যান সাধারণ মানুষ। যে যত বড় ‘আমি’, তিনি তত বড় নেতা।

কিছু দিন আগে রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে একদা বামপন্থী অধুনা তাত্ত্বিক এক বিজেপি নেতার সাংবাদিক বৈঠক মনে পড়ছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি কত জরুরি তা-ই বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি। সাংবাদিকের পাল্টা প্রশ্ন ছিল, নাগরিকের পক্ষে সত্যিই কি নাগরিকত্বের প্রমাণ দেওয়া সম্ভব? জন্মের পর থেকে রাষ্ট্র একের পর এক পরিচয়পত্র দিতে থাকে ব্যক্তিকে। জন্মের নথি, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট... এ ভাবেই রাষ্ট্র নিজের ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। বিদেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থীদেরও নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্য দিয়ে নাগরিকত্ব অর্জন করতে হয়। তবে সে ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রই তাঁদের পরিচয়পত্র দেয়। অভিযোগ, সেই সব নথি জাল হয়। জাল নথি প্রদর্শন অপরাধ। কিন্তু জাতীয় নাগরিক পঞ্জির ক্ষেত্রে তো কেবল জাল নথি ধরা হচ্ছে না! বৈধ পরিচয়পত্রকেও চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রের দেওয়া কাগজ রাষ্ট্রই চ্যালেঞ্জ করতে পারে তো?

তেলেবেগুন উত্তর দিয়েছিলেন ওই তাত্ত্বিক নেতা— ‘‘রাষ্ট্র আবার কী? সরকারই রাষ্ট্র। নথি সরকার দেয়। বিগত সরকার ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে অনুপ্রবেশকারীদের পরিচয়পত্র পাইয়ে দিয়েছিল। গোটা দেশে নরেন্দ্র মোদী সেটাই ছাঁকতে চাইছেন।’’

সরকারই যখন রাষ্ট্র হয়ে যায়, তখন আলোচনা এগোয় না। আরও ভাবনার বিষয় হল, রাষ্ট্রপ্রধানেরা সরকার বলতে বুঝছেন শুধুই নিজেকে। দিকে দিকে ষোড়শ লুই। ফলে এক একটি ‘আমি’ ইচ্ছে মতো গুলিয়ে দিচ্ছে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, ধর্ম...

অথচ সমাজ-রাষ্ট্রের চিরাচরিত সংজ্ঞা তো ঠিক এমন নয়! প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে ‘প্রতিনিধি’ শব্দটির যে গুরুত্ব, চলতা ফিরতা গণতন্ত্রে ছিটেফোঁটাও কি তার আভাস মেলে? নেতারা কবি-সাহিত্যিকদের ‘বাস্তবজ্ঞানবিবর্জিত’ বলে মনে করেন। রবিঠাকুরেরা কেবলই বক্তৃতার উদ্ধৃতি। কিন্তু সভ্যতার বিভিন্ন পর্বে রাজনৈতিক দার্শনিকেরা যে স্বপ্নের সমাজ দেখেছিলেন, সেখানেও তো ‘আমি’ বর্জনেরই ডাক দেওয়া হয়েছে বারংবার! মান্যতা পেয়েছে ‘আমরা’।

মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কৌম চেতনায় সে ভাবনা স্পষ্ট। ১৮৪৪ সালে তরুণ কার্ল মার্ক্স লিখছেন, "In my expression of my life I would have fasioned your expression of your life, and thus in my own activity have realised my own essence, my human, my communal essence." (কমিউনাল শব্দটি এখানে কমিউনিটি বা কৌম অর্থে ব্যবহৃত)।

আহীরদের অবশ্যই চিকিৎসা দরকার। যদিও অটিজ়ম আদৌ অসুখ কি না, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে ‘আমি’র বোধ প্রসঙ্গেও। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সমাজে বাস করতে হলে ‘আমি’ শিখতেই হয়।

কিন্তু ‘অতি আমি’র প্রবণতা অসুস্থতা নয়? আমিকেই যাঁরা রাষ্ট্র ভাবছেন, তাঁরা সুস্থ তো?

কাতিয়ুশার পাগলা বুড়োকে আমরা কি তবে ‘পাগল’ই বলব?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Autism Children First Person
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE