Advertisement
১০ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

অচল পত্র

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, সে বস্তুটি বার কয়েক হাতে আসিয়াছে রাজ্যবাসীর।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, সে বস্তুটি বার কয়েক হাতে আসিয়াছে রাজ্যবাসীর। প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি। নরেন্দ্র মোদী অভিনন্দন জানাইয়াছেন ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে নাম লিখাইবার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী লিখিয়াছেন, নানা সামাজিক প্রকল্পে স্কুলপড়ুয়াদের জীবনের মান উন্নত হওয়াতে তিনি আনন্দিত। উন্নয়নের যজ্ঞে অভিভাবকদের যোগ দিতে আহ্বানও করিয়াছেন। পত্র পাঠ করিয়া রাজ্যবাসী কে কতটা উৎফুল্ল হইলেন জানা নাই। তবে সংবাদে প্রকাশ, স্কুল কর্তৃপক্ষের একাংশ পত্রবাহকের কাজটি পাইয়া কিছু ক্ষুব্ধ। তাঁহাদের দোষ নাই, স্কুলশিক্ষকদের কর্তব্য তালিকা দীর্ঘ ও বিচিত্র। তাহার উপর কয়েক শত অভিভাবকের নামাঙ্কিত চিঠি বিলি করিবার দায়িত্ব চাপিলে খুশি হইবার কী কারণ থাকিতে পারে? কিন্তু অসন্তোষের আসল কারণ অন্যত্র। বিবিধ সরকারি প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ দিয়া নাগরিকদের নামে নামে চিঠি দিবার প্রয়োজন পড়িল কেন? ইহা প্রকল্পের প্রচার হইতে পারে না, তাহার জন্য দিবানিশি বিজ্ঞাপন চলিতেছে। আর, যাঁহারা চিঠি পাইয়াছেন, তাঁহারা ইতিমধ্যেই প্রকল্পের সুবিধা পাইয়াছেন। তবে কি চিঠির না-বলা বাণী ইহাই যে, স্বাক্ষরকর্তা প্রকল্পের সুবিধা পৌঁছাইয়া দিয়াছেন, অতএব সমর্থন তাঁহারই প্রাপ্য? এই জন্যই কি প্রতিযোগিতা করিয়া চিঠি পাঠানো চলিতেছে? স্বাস্থ্যপ্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর চিঠি তো শিক্ষাপ্রকল্পে মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি, যেন তাসের উপরে তাস। প্রশ্ন স্বাভাবিক: জনগণের টাকায় ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা রাজনৈতিক প্রচার কেন করিবেন?

সরকারি প্রকল্পে নাগরিকের উন্নয়নের জন্য নাগরিকের টাকা খরচ করা হয়, সরকার তাহার পরিকল্পনা ও রূপায়ণের দায়িত্ব পাইয়াছেমাত্র। সরকারি অনুদান দেওয়া হয় রাজকোষ হইতে। বরাদ্দের সিদ্ধান্তে বিরোধীদেরও কৃতিত্ব আছে, যে হেতু তাঁহারাও বাজেট পাশ করিয়া থাকেন। রূপায়ণে কৃতিত্ব আছে সরকারি আধিকারিকেরও। প্রকল্পে বরাদ্দ ও ব্যয়কে কোনও নেতা-মন্ত্রী নিজের ‘কৃতিত্ব’ বলিয়া দাবি করিতে পারেন না। অতএব প্রকল্পের উপভোক্তাদের নিকট স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠাইবার সিদ্ধান্তে এমন এক মিথ্যা আস্ফালন প্রকাশ পায়, যাহা জনমানসকে পীড়িত করিতে বাধ্য। কারণ ইহা নাগরিকের সম্মান খর্ব করে। গণতন্ত্রে ‘সবাই রাজা’, কেহ নির্বাচিত প্রতিনিধির দাক্ষিণ্যের প্রত্যাশী নহেন। বরং প্রতিনিধিই তাঁহার নির্বাচকদের নিকট দায়বদ্ধ। অতএব নির্বাচনের পূর্বে চিঠি দিতেই যদি হয়, তবে তাহাতে সকল প্রকল্পের বরাদ্দ-ব্যয়ের হিসাব পাঠানোই সঙ্গত। অভিনন্দন জানাইতে কিংবা প্রতিশ্রুতি দিতে বাড়ি বাড়ি চিঠি পাঠাইবার প্রয়োজন নাই, তাহার জন্য দলের খরচে দলীয় প্রচারসভা করাই সঙ্গত।

আক্ষেপ, গত কয়েক বৎসরে সরকারি প্রচার এবং দলীয় প্রচারের পার্থক্য ক্রমে কমিয়াছে। সর্বত্র একই মুখচ্ছবি, একই সাফল্যের আখ্যান। এমনকি দলীয় প্রচার মঞ্চের দাবির সহিত বাজেট বক্তৃতার তথ্য-পরিসংখ্যানও মিলিয়া যাইতেছে। শেষ প্রশ্ন, চিঠির প্রয়োজন কী? নেতারা কে কী করিয়াছেন, পূর্বে সে কথা ঘরে ঘরে প্রচার করিতেন দলীয় কর্মীরা। এবং নাগরিকের অভিযোগ-প্রত্যাশার কথাও জানাইতেন নেতাদের। জনসংযোগের সেই গণতান্ত্রিক রীতিতে কি তবে নেতাদের ভরসা নাই? কিন্তু, ডাকবাক্সে চিঠি, মোবাইল ফোনে বার্তা হৃদয় ছুঁইতে পারিবে কি?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE