যে পদটিরই আদৌ কোনও প্রয়োজন নাই, তাহার এক্তিয়ারের সীমা আলোচনা করিয়া এক বেলা কাটিল। বারো বৎসর পর আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠক বসিয়াছিল। আলোচ্য ছিল, রাজ্যপালের ভূমিকা। যে কথাটি বলিয়াই বৈঠক সাঙ্গ করা চলিত, সেই কথাটি বলিয়াছে একমাত্র বিহার— রাজ্যপাল পদটিই অপ্রয়োজনীয়। একটি ঔপনিবেশিক অভ্যাস বহন করিয়া চলা ভিন্ন এই পদের আর কোনও গুরুত্ব নাই। তিনি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান, কিন্তু সেই গৌরব নেহাতই আলঙ্কারিক। প্রশাসনে তাঁহার ভূমিকা নাই, এবং তাহা না থাকাই বাঞ্ছনীয়। এই অপ্রাসঙ্গিক অস্তিত্বের বরং সমস্যা আছে। যেখানে মুখ বন্ধ রাখাই কর্তব্য, অনেক রাজ্যপালই তেমন ক্ষেত্রে নিজের মতামত জাহির করিয়া জট পাকাইয়া তোলেন। অবশ্য, এই সমস্যাটি তুলনায় গৌণ। যে রাজ্যগুলি বর্তমানে বিজেপি-শাসিত নহে, রাজ্যপাল বিষয়ে তাহাদের প্রধান সমস্যা, এই পদের অধিকারীর রাজনৈতিক ব্যবহার। হিমাচলপ্রদেশ বা অরুণাচলপ্রদেশে রাজ্যপালরা যে ভঙ্গিতে সরকার ভাঙিয়া দেওয়ার চেষ্টা করিয়াছেন, অথবা গোয়া-মণিপুরে যে ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করিতে পারা সত্ত্বেও বিজেপি সরকার গড়িবার ডাক পাইয়াছে, তাহা গণতান্ত্রিক নহে। কেহ অভিযোগ করিতেই পারেন যে রাজ্যপালরা অদৃশ্য সুতার টানে নড়িতেছেন। সেই সুতা বাঁধা রহিয়াছে নাগপুরে।
গত আড়াই বৎসরে যত রাজ্যপাল নিযুক্ত হইয়াছেন, ব্যতিক্রমহীন ভাবে তাঁহারা প্রত্যেকেই ভারতীয় জনতা পার্টির সহিত যুক্ত। সেই তালিকায় যেমন মৃদুলা সিংহ বা তথাগত রায়রা আছেন, যাঁহারা রাজ্যপালের পদে বসিবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বিজেপি-র ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভের সদস্য ছিলেন, তেমনই আছেন বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অনপনেয় কলঙ্কের অধিকারী কল্যাণ সিংহ। আরও আছেন বলরামদাস টণ্ডন ও রাম নায়েকের ন্যায় স্বয়ংসেবকরা। রাজ্যপালের পদটি যদিও দাবি করে যে তাহার অধিকারী নিজের রাজনৈতিক পক্ষপাতকে পিছনে ফেলিয়া তবেই সেই পদে বসিবেন, কিন্তু তাহা নেহাতই কেতাবি কথা। রাজ্যপালের কুর্সিতে রাজনৈতিক রং বিপজ্জনক রকম প্রকট হইয়া উঠিয়াছে। অ-বিজেপি রাজ্যগুলি বিচলিত হইলে তাহা অস্বাভাবিক নহে। রাজ্যপালের পদটি যদি রাখিতেই হয়, তবে তাহার জন্য একটি ‘কুলিং অফ পিরিয়ড’ রাখাও বিধেয়— কোনও রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পদে থাকিবার পর একটি নির্দিষ্ট সময় পার না হওয়া অবধি কেহ রাজ্যপাল হইতে পারিবেন না। কেহ লোকসভা ভোটে হারিলে, বা রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিচয় দিলে, অথবা কাহাকে রাজনৈতিক বানপ্রস্থে পাঠানো প্রয়োজন হইয়া উঠিলেই যে তাঁহাকে কোনও রাজ্যে রাজ্যপাল করিয়া দেওয়া না যায়, তাহার জন্যই ব্যবস্থা জরুরি।
দৃশ্যত, সরকার গঠন এবং সরকারের পতন, যে দুইটি ক্ষেত্রে রাজ্যপালের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রহিয়াছে, ক্ষমতার রাজনৈতিক অপব্যবহারও সেই দুইটি ক্ষেত্রেই ঘটিতেছে। প্রবণতাটিকে ঠেকাইবার উপায়, রাজ্যপালের নিজস্ব মতপ্রয়োগের সুযোগ না রাখা। নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়া, এবং তাঁহাকে সেই নিয়মের গণ্ডিতে থাকিতে বাধ্য করা। পরিষদের বৈঠকে পুঞ্ছি কমিশনের সুপারিশের কথা আসিয়াছে। কোনও সরকারকে বরখাস্ত করিতে হইলে কোন নিয়ম মানিতেই হইবে, অথবা কোন দলকে সরকার গঠন করিতে ডাকা হইবে, তাহা যে নিয়ম মানিয়া স্থির করা হইবে— সে বিষয়ে কমিশনের স্পষ্ট সুপারিশ রহিয়াছে। সেই সুপারিশই মানা হইবে, না কি রাজ্যগুলি মিলিত ভাবে রাজ্যপালের এক্তিয়ারের সীমা নির্ধারণ করিবে, তাহা স্থির করিতে হইবে। কিন্তু, রাজভবনের মাধ্যমে দিল্লি হইতে রাজ্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করিবার খেলাটি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার স্বার্থে বন্ধ করা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy