Advertisement
১০ মে ২০২৪

রাজনীতির অনাথ সন্তান

এ বার অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে প্রচুর পাট। তবু দর ওঠেনি কেন? হুগলিতে, উত্তর চব্বিশ পরগনায়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদে পাটচাষিরা হাত উল্টে দিলেন। দু’বছর আগে পাঁচ হাজার টাকা কুইন্টাল ছা়ড়িয়েছিল পাট।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৪০
Share: Save:

পুজো গেল। এল লক্ষ্মীপুজো। বাংলার পাটচাষির কাছে দেবী এ বার নিম অন্নপূর্ণা। পাটের দাম নেই। চাষের খরচ উঠছে না অধিকাংশ চাষির। শিল্পমহলের সমীক্ষা, বাজারদর সরকারি দরের চেয়ে কুইন্টাল প্রতি ৪০০ টাকা কম। গত বছরের পাট আজও ঘরে পড়ে। পাটকাঠির পাঁজা ঢাকা প্লাস্টিকে। ‘দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে কবেই, এখন হাড় দিয়ে ঠেলছি,’ বললেন দত্তপুকুরের ডোঙাপুর গ্রামের মহম্মদ ইসলাম আলি। বাংলার তিরিশ লক্ষ পাটচাষির এক জন।

এ বার অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে প্রচুর পাট। তবু দর ওঠেনি কেন? হুগলিতে, উত্তর চব্বিশ পরগনায়, নদিয়া-মুর্শিদাবাদে পাটচাষিরা হাত উল্টে দিলেন। দু’বছর আগে পাঁচ হাজার টাকা কুইন্টাল ছা়ড়িয়েছিল পাট। এ বার তিন হাজার টাকাও উঠছে না। মন্দ কপাল। হয়তো পরের বছর দর বাড়বে।

সত্যি দর বাড়বে কি? পাটের বাজার যে মেরেছে সরকারি নীতি, বাংলার চাষি তা জানেন না। পাটের ব্যবহার কেন্দ্র ক্রমাগত কমাচ্ছে। প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন ২০১২ সালে অর্থমন্ত্রিত্ব ছাড়লেন, তখনও খাদ্যশস্য আর চিনির ১০০ শতাংশ বস্তার জন্য পাট নেওয়া ছিল আবশ্যক। এখন তা দাঁড়িয়েছে চাল-গমে ৯০ শতাংশ, চিনিতে ২০ শতাংশে। খাদ্য নিগম, চিনিকল মালিক সংগঠন, চিনি সমবায় সংগঠন, সকলেই পাটের বস্তা কমাতে, বাতিল করতে চায়। বস্ত্র মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটি সর্বশেষ প্রস্তাব দিয়েছে, ধাপে ধাপে কমিয়ে ২০২৪ সালে শস্যে ৫০ শতাংশ এবং চিনিতে শূন্য শতাংশ বস্তা হবে পাটের।

রাজ্য কি পাটের পুনরুজ্জীবন চায়? না কি তার ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করে? সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করেনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শোনা যায়নি কেন্দ্রের পাটনীতির নিন্দা। হয়তো তাঁর মনে আছে, ২০১৪ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রের বস্ত্র মন্ত্রক এ রাজ্যের মুখ্য সচিবকে চিঠি পাঠিয়ে বলেছিল, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চালকল পাটের বস্তা ব্যবহার করছে না। রাজ্য তাদের বাধ্য করুক। আলুর বস্তার জন্যও পাট আবশ্যক করুক। যদি আলুর জন্য পাটের বস্তা আবশ্যক হত, তা হলে বছরে অন্তত বারো লক্ষ বেল (এক বেল মানে ১.৮ কুইন্টাল) পাটের চাহিদা তৈরি হত, বলছে শিল্পমহল। কেন্দ্রের তর্জন বা শিল্পপতিদের আবেদনে কাজ হয়নি। হওয়া কঠিন। প্লাস্টিকের বস্তার দাম অনেকটা কম।

ফসলের ন্যূনতম দাম নিশ্চিত করার উপায় রাষ্ট্রায়ত্ত নিগম দ্বারা ন্যায্যমূল্যে খরিদ। পাট নিগম ২০০৭-০৮ সালে ন্যূনতম দরে পাট কিনেছিল সাড়ে সাত লক্ষ বেল। গত বছর কিনেছে ৫৬ হাজার বেল। আশির দশকে ১৭১টি কেন্দ্রে পাট কেনা হত, এ বছর এখনও অবধি কাজ করছে গোটা তিরিশ। ফলে পাটের বাজারে তার প্রভাব নেই। আড়তদার যা বলছে, তা-ই বাজারদর।

এ-ও লক্ষ করার মতো যে, গত ছয় বছরে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস বা বিজেপি, কোনও বিরোধী দল পাটচাষির এই ধারাবাহিক বঞ্চনা নিয়ে বড়সড় প্রতিবাদ করেনি। ধান, আলু নিয়ে হইচই, পাট নিয়ে সবাই নীরব। মুর্শিদাবাদের চাষিরা বললেন, ‘বর্ধমানের জোর বেশি।’

বাংলার নেতাদের নীরবতার সুযোগে কেন্দ্র এ বছর যা নির্দেশ দিল, তা অন্তত অর্ধেক পাটচাষিকে পথে বসাল। কেন্দ্র যে বস্তা কিনত, তার ওজন এত দিন ছিল সর্বাধিক ৬৬৫ গ্রাম। এ বার বিজ্ঞপ্তি, ওজন হতে হবে ৫৮০ গ্রাম। এত হালকা বস্তার জন্য চাই উন্নত মানের পাট। যা পশ্চিমবঙ্গের পাটের ২০-৩০ শতাংশ। আরও আপশোসের কথা, ভাল মানের পাট অধিকাংশই হয় উত্তরবঙ্গ, হুগলি আর উত্তর ২৪ পরগনায়। নদিয়া-মুর্শিদাবাদের চাষি, যাঁরা অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম, তাঁদের পাট অনুজ্জ্বল, ভারী, নিচু মানের। কেন্দ্রের এক নির্দেশে তাঁরা ‘বাতিল’ হয়ে গেলেন। পাট বোঝাই গাড়ি জেলা থেকে গিয়ে ফিরে আসছে। কিনছে না মিল।

কেন বাংলার অধিকাংশ পাট অচল হল? কেন্দ্র বলছে, হালকা বস্তা চলে বেশি, তাই তিনশো কোটি টাকা বাঁচবে। কিন্তু চাষি যে মরবে?

সরকার যে মানের পাট চাইছে, বাংলার চাষি চাইলেও তা ফলাতে পারবে না। প্রথম কারণ জলের অভাব। ‘শিয়ালমারি নদীর উপর বাড়ি হয়ে গিয়েছে, পদ্মার সঙ্গে সংগম বুজিয়ে দেওয়ায় স্রোত চলে গিয়েছে,’ আক্ষেপ করলেন ডোমকলের নুরুল হুদা মণ্ডল। ফলে নিচু জমিতে জমে-থাকা বর্ষার জল ভরসা। পাট-পচানো জলে ফের পাট পচাতে হয়। ‘গায়ে যা দুর্গন্ধ হয়, বাড়ির লোক ঢুকতে দিতে চায় না।’ কাদা-জলে পচিয়ে পাটের রং চলে যায়। যে সব অঞ্চলে আগে উন্নত পাট হত, সেখানেও মান নেমেছে। দ্বিতীয়ত, দেশে যত পাটবীজ প্রয়োজন তার মাত্র তিরিশ শতাংশের সরকারি শংসাপত্র রয়েছে। ভুয়ো বীজ নিয়ে নাকাল চাষি। পাট নিগম যখন বীজ বিলি করে, এমন ভিড়, হুড়োহুড়ি হয় যে পুলিশ ডাকতে হয়, বলছিলেন নিগমের একটি কেন্দ্রের কর্মীরা।

চাষি যত বিপন্ন হচ্ছে, তত ক়ড়া হচ্ছে সরকার। এ বছর পাটে জলীয় অংশ ১৮ শতাংশের বেশি থাকলে কিনছে না পাট নিগম। এত কম ‘ময়শ্চার লেভেল’ আগে কখনও ধার্য হয়নি। নিগম কর্মীরাই মানছেন, সদ্য-ওঠা পাটে এত কম জল আশা করা যায় না। নিগমের পরীক্ষায় সব চাষি ফেল। অতএব বাংলার পাটের বাজার দালাল-আড়তদারের মুক্তরাজ্য। উন্নত পাটের চাহিদা থাকলেও তারা দাম উঠতে দিচ্ছে না। কম দামে কিনে মজুত করছে।

বাংলার লক্ষ লক্ষ পাটচাষির লোকসান করে কেন্দ্র কী লাভ করবে, পাটের বদলে প্লাস্টিক ব্যবহারের কী খেসারত দিতে হবে দেশকে, সে প্রশ্ন বিধানসভা বা সংসদে উঠছে না। যদিও এ রাজ্যে পাট উৎপাদন হয়, এমন অঞ্চল থেকে সাংসদ অন্তত ২৭, বিধায়ক ১৭৬ জন।

সবাই দেখছেন, পথে বসছে পাটচাষি। যদি পাটশিল্পের ভবিষ্যৎ না-ই থাকে, যদি তা কোটা-সর্বস্ব, অলাভজনক বলে বিবেচিত হয়, তা হলে বিকল্প চাষের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে না কেন? কেন আজগুবি গল্প ফাঁদছেন নেতা-আমলারা? কখনও বলছেন, অল্প জলে উন্নত পাট তৈরি শেখাব। কখনও বলছেন, রাস্তা নির্মাণের জন্য পাট কিনব। এত সমাধান যদি থাকে, তবে নদিয়া-মুর্শিদাবাদে বিঘের পর বিঘে জমিতে কেন লাল হচ্ছে না-কাটা পাট? দিনে আটশো টাকার জল, মাথাপিছু আড়াইশো-তিনশো টাকা মজুরি দিয়ে যে পাট বুনেছিল চাষি?

নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে যখন মানুষের স্বার্থরক্ষার সম্পর্ক হারিয়ে যায়, তখন এমনই বেকুব বনতে হয় গরিবকে। গায়ের জোরে যারা ‘ভোট করায়’, তাদের হাতে-মারাটা চোখে পড়ে। ভাতে-মারার ছবি দেখতে হলে গিয়ে দাঁড়াতে হয় পাটচাষির ঘরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jute excessive rainfall Jute farmers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE