সর্বভারতীয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাল্লা দেওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে কচিকাঁচা শিশুদের শৈশব থেকে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে রাজ্যের একাধিক সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পঠনপাঠন চালু হচ্ছে। বিগত বাম সরকারের আমলে ইংরেজি ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে চালু হওয়ার ফলে যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেক অভিভাবক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করান। বস্তুত সেই সময় থেকেই রাজ্যে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বাড়বাড়ন্ত।
একটু আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন পরিবার তাদের সন্তানকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে বর্তমানে ভর্তি করান না। এমনকি, কলকাতার অনেক নামি বাংলা মাধ্যম স্কুলেও পড়ুয়া বাড়ন্ত। শহর ও শহরতলি এলাকায় বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি পড়ুয়াহীনতায় ভুগছে। মফস্সলেও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থাবা বসিয়েছে।
সমাজের প্রান্তিক পরিবারের সন্তানেরা কেবল মাত্র আজ সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের পড়ুয়া। অর্থনৈতিক সঙ্গতিসম্পন্ন ও অভিজাত বাঙালি পরিবারে বাঙালিয়ানা আস্তে আস্তে উধাও হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে ইংরেজি-হিন্দির সংস্কৃতি চর্চা। এমনকি, বর্তমানে বাংলা ব্যান্ডগানে বিকৃত বাংলা উচ্চারণ কানে বড় পীড়া দেয়। ঘরে-বাইরে সর্বত্র বেআব্রু হয়ে পড়ছে বাঙালি সংস্কৃতি-কৃষ্টি এবং বাংলা ভাষা। একে কেন্দ্র করে বাঙালি সমাজ স্পষ্টতই দ্বিধাবিভক্ত।
অনেকের প্রশ্ন, বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ কী? বাংলা ভাষা কি বিপন্ন নয়? এই মুহূর্তে মনে হয়, বাংলা ভাষা অস্তিত্বের সঙ্কটে না পড়লেও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠার যথেষ্ট কারণ আছে। দু’টি দিক থেকে বিপদ তৈরি হয়েছে। এক দিকে, সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণির বাংলাচর্চা পরিত্যাগ ও প্রায় একক ভাষা হিসাবে ইংরেজি চর্চা ও ব্যবহারের প্রতি ঝোঁক বৃদ্ধি। পৃথিবী থেকে প্রতি পনেরো দিনে একটি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বাংলার সে ভয় নেই, কারণ বাংলাদেশ। পশ্চিমবঙ্গবাসীর তুলনায় বাংলাদেশিরা বাংলা ভাষার প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল, যত্নশীল।
বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের সংখ্যা সব মিলে ত্রিশ কোটির বেশি। সংখ্যার বিচারে পঞ্চম ভাষা বাংলা। ভাষা নদীর মতো বহতা, তার পরিবর্তন, রূপান্তর ঘটে। গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে সচল ভাষা সমৃদ্ধি অর্জন করে চলে। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলা ভাষা বিপন্ন না হলেও আজকের দিনে তা একটি বর্ধিষ্ণু ভাষা কিনা। না কি, বাংলা ভাষা একটি ক্ষয়ের পর্ব অতিক্রম করছে? রাষ্ট্রে ও সমাজে ক্ষমতাবান শ্রেণি বাংলাচর্চা ত্যাগ করে ইংরেজি-হিন্দিমুখী হচ্ছেন। বাংলা এই শ্রেণির মানুষের কথ্য ভাষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। এই কথ্য বাংলা একদিকে আঞ্চলিকতায় পীড়িত, অন্য দিকে, ইংরেজি-হিন্দি শব্দের অপপ্রয়োগে ভারাক্রান্ত। সংবাদের মতো আনুষ্ঠানিক পাঠ্যে দেদার ইংরেজি ও হিন্দি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কৌশলই অনুসরণ করছে হালে জনপ্রিয় এফ এম রেডিও জকিরা। টিভি, রাস্তাঘাট এমনকি সরকারি দফতরেও বিকৃত বাংলায় বিজ্ঞাপন। ভাষার প্রতি অনীহা এবং অশ্রদ্ধা থেকেই এই ধরনের বিকৃত প্রদর্শনী।
ইংরেজি ভাষা চলছে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে, সংখ্যায় বাড়তে থাকা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলিতে, শপিং মলে, কর্পোরেট সেক্টরে, শহরের অভিজাত পাড়ায় পাড়ায়। মোদ্দা কথা, একুশ শতকের বাঙালি প্রজন্ম ইংরেজির প্রতি যতটা আগ্রহী, বাংলার প্রতি ততটা নয়।
একটি ভাষার বেড়ে ওঠা, প্রচার-প্রসারের পিছনে বহু ত্যাগ থাকে, থাকে সীমাহীন শ্রম, সাধনা। বাংলা ভাষার জন্মলগ্ন থেকে অধুনাকাল অবধি বিবর্তন সেই সাক্ষীই বহন করে। ১৯৫২ সালে ২১ ফ্রেবুয়ারি বাংলাদেশিরা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দিয়েছে। সালাম, বকরত, রফিক, শফিউর, জব্বার সঙ্গে কিশোর অহিউল্লাহও শহিদ হয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ ২১ ফ্রেবুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অসমের বাঙালিদের উপর ‘অসমিয়া’ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬১ সালে ১৯ মে প্রতিবাদে রাজপথে নামে অসমের মানুষ। সে দিন পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ১১ জন। যখনই কোনও শক্তি বা দেশ অন্য কোনও দেশকে দখল করেছে, পরাজিত করেছে, শাসন করেছে তারা ওই জাতি, দেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে দখলকৃতদের ভাষা, সংস্কৃতি।
ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। অসীম প্রকাশ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণী এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায় এবং ওই মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশ বেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে।
যখন কোনও ভাষার ব্যবহারকারী অবশিষ্ট থাকে না, তখনই ভাষা হারিয়ে যায় বা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এবং তা অন্তর্হিত বা মৃত ভাষা হিসাবে পরিগণিত হয়। সংরক্ষিত বা লিখিত পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন ও গবেষণার মাধ্যমে বিলুপ্ত ভাষা বা মৃত ভাষা অবলোকিত হয়। যদিও সমগ্র মানব ইতিহাসে বিভিন্ন ভাষা ক্রমাগত নানা কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে, তবুও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বায়ন, নব্য ঔপনিবেশবাদ এবং অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী ভাষা অন্য ভাষার উপর আধিপত্য বিস্তারের ফলে আশঙ্কাজনক হারে অনেক ভাষা পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বাংলা ভাষাও সেই রোগে আক্রান্ত।
অধিক প্রচলিত ভাষা তুলনামূলক কম প্রচলিত ভাষার উপর প্রভাব বিস্তার করে। ফলে, শেষমেষ তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। বিশ্বে বর্তমানে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ৬০০০ থেকে ৭০০০। এর মধ্যে আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই এর নব্বই শতাংশ হারিয়ে যাবে বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। ২০টি অধিক প্রচলিত ও পরিচিত ভাষার প্রত্যেকটিতে কথা বলে ৫০ মিলিয়নের বেশি লোক, যা বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক। অপর দিকে, অন্য ভাষাগুলোতে কথা বলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা, যার সংখ্যা ১০,০০০এর অধিক হবে না। বিশ্বের ১১টি সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা হল চিনা, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্পেনীয়, আরবি, পর্তুগিজ, রুশ, বাংলা, জাপানি, জার্মান ও ফরাসি।
এই সব ক’টি ভাষা ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এবং বিশ্বের ৪৬ শতাংশ মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। (চলবে)
শিকারপুর উচ্চ উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy