সোনার দোকানের এক মালিক বলছিলেন তাঁর ক্রেতাকে? ‘‘বাংলা শিখে কী হবে? বাংলা তো ভারতে চলে না। বরং সবার ইংরেজি মাধ্যমে মিডিয়ামে পড়া উচিত।’’ সব শোনার পর সেই ক্রেতা বলেছিলেন, ‘‘আপনার মা-বাবাকেও তো ভারতে কার্যত কেউ চেনে না। কিন্তু তা বলে কি আপনি আপনার বাবা–মাকে অস্বীকার করতে পারবেন?’’ সেই আপাত সরল ক্রেতা মানুষটি স্বর্ণ ব্যবসায়ীটিকে আরও বলেছিলেন, ‘‘ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেই ইংরেজি শেখা যায় না। ইংরেজি একটা ভাষা। তা বাংলা মাধ্যমে পড়েও শেখা সম্ভব। ইংরেজি মাধ্যমে মানুষ ইংরেজি ভাষা শিখতে যায় না, ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষা নিতে যায়।’’ এই যুক্তিবাদী মানসিকতা ক’টা বাঙালির আছে!
আজকে পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলেমেয়েরা এক মরিচিকার পিছনে ছোটার মতো ইংরেজি মাধ্যমে ছুটছে। বেসরকারি স্কুলগুলোর পরিকাঠামো কেমন, শিক্ষক কতটা তাঁর পেশায় পারদর্শী, এ সব বিচার না করেই ছুটছে। সে সব প্রতিষ্ঠানে যত না শিক্ষা বিতরণ হয়, তার চেয়ে বেশি চলে শিক্ষার নামে ব্যবসা। আর বাঙালি ইংরেজিতে তথাকথিত শিক্ষিত হতে চেয়ে তাই চেটেপুটে গ্রহণ করছে!
সে যুগের বাঙালি আর আজকের বাঙালির মধ্যে তাই বিস্তর ফারাক। দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আগের বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুললে অমর সব শহিদ বাঙালির নাম পাওয়া যায়। তারপর দ্বিখণ্ডিত হল বাঙালির জাতিসত্তা। এক জাতি, দুই দেশ। কিন্তু সম্পর্ক মুছে ফেলা যায় না! সম্পর্ক, পিছুটান, ভালবাসা, নির্ভরতা জড়িয়ে ছিল। জাতিসত্তাকে দ্বিখণ্ডিত করলেই সব মুছে ফেলা যায় না। তাই ওপাশের বাঙালির জন্য এপাশের বাঙালির প্রাণ কাঁদবেই। হোক না দেশ আলাদা, উভয় বাঙালি পরষ্পরের সুখদুঃখের অংশীদার হবেই। সেই বাঙালির কাছেই যখন ধমক- চমক আসে যে, হিন্দি বলতেই হবে, তখন তার জাতিসত্তা পুরনো অম্লশূল বেদনার মতো জেগে উঠবেই। প্রশ্নটা হল, যাঁদের বাঙালিত্ব জেগে উঠল সাম্প্রতিক হিন্দি আগ্রাসনের সৌজন্যে, তাঁরা এতদিন কোথায় ছিলেন? কেউ চাপিয়ে না দিলেও বাঙালি এতদিন ইচ্ছে করেই বাংলাভাষা ভুলতে চেয়েছে। পদে পদে বাঙালি নিজের মাতৃভাষাকে অপমান করেছে। রাজ্যের বাইরে তো বাদই দিলাম, দিঘার সমুদ্রতট কিংবা দার্জিলিং পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েও বাঙালি অচেনা বাঙালির সঙ্গে প্রথমে হিন্দিতেই কথা বলা পছন্দে করে এসেছে। নতুন ভাড়াটে যদি অবাঙালি হলে ভুল হিন্দিতে আলাপ শুরু করেছে। নিজের ছেলেমেয়ের ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ গর্ব করে বলেছে। এবং সেই একই সূত্রে আজ বাঙালি নববধূর আগমনে সপরিবার ডিজে-তাড়িত হয়ে রাস্তায় নামে!
ব্যাঙ্কের সই কটা বাঙালি বাংলায় করেন? আজকের বাঙালি তাঁর সন্তানকেও সামর্থ্য থাকলে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ান। তাঁর কাছে সহজ যুক্তি বা ছুতো আছে— আগামী দিনে সর্বভারতীয় পরীক্ষায় সাফল্য পেতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনাটা জরুরি। কিন্তু তার জন্য বাঙালি বাংলাভাষা ভুলতে চেয়েছে, তা নয়। আসলে, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় থেকে বাঙালি সেই ইংরেজ আমলে পাওয়া ইংরেজি শিক্ষার জন্য কেরানিগিরির সাফল্যকেই বেছে নিতে চেয়েছে। অসুবিধা নেই। বাঙালি তো ‘ইনটেলেকচুয়াল’ জাতি। সে একটা ভাষা শিখবে কেন! সে আরও বহুভাষায় পারদর্শী হোক। কিন্তু নিজের ভাষাকে আগে নিজে সম্মান করুক। নিজের মাকে ভাল না বেসে প্রতিবেশীর মায়ের প্রতি দরদ উথলে পড়তে দেখলে বিস্ময় তো জাগেই!
বাঙালি আজ ইতিহাসবিস্মৃত। অনুকরণপ্রিয়। মাতৃভাষার প্রতি দরদ তাই অনেকটাই লোকদেখানো। গঙ্গাতীরবর্তী অঞ্চলের কথ্য ভাষাই নাকি বাংলা কথ্যভাষার আদর্শ রূপ! আর উত্তরের মানুষের, উপভাষিক অঞ্চলের মানুষের ভাষা শুলে নাকি নাক সিটকোয়! অথচ মাটির গন্ধমাখা বাংলাভাষার বৈশিষ্ট্যই তো প্রতিটি কথ্য উচ্চারণের ধ্বনি! কলকাতার বাসে একজন আরেকজনকে যদি বলেন— ‘কী দিয়া ভাত খাইচেন?’ তা হলে একটু আড়চোখে তাকিয়ে দেখে নেবেনই মহানাগরিক বাঙালি! অথচ, এই বাঙালিই আবার সেজেগুজে মঞ্চে গায়— ‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে’!
(লেখক শিক্ষক দক্ষিণ দিনাজপুরের মহাদেববাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)