এমন নয় যে এর আগে বাঙালি সমাজে দুর্নীতি ছিল না। সাড়ে তিন দশকের বাম আমলেও কিন্তু অনেক বারই দুর্নীতি বা ঘুষের অভিযোগ উঠেছিল। অভিযোগের আঁচ লেগেছিল স্বয়ং জ্যোতি বসুর গায়েও! কিছু কিছু বামপন্থী নেতাও কখনও ‘চোরেদের সরকার’, কখনও বা ‘ঠিকাদারদের সরকার’ অভিযোগ তুলেছেন। বিভিন্ন শিল্পে মাঝে মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের নামেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তার পরে পরিবর্তন। তৃণমূল সরকারের এক বছর পূর্তি হতে না হতেই সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি সামনে এল, বেশ কয়েক জন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীর হাজতবাস হল, কারও কারও এখনও সে পর্ব চলছে । ‘মুই চোর না তুই চোর’, তা নিয়ে তৃণমূল ও বামপন্থীদের হাজার বাগ্বিতণ্ডা চললেও, হাজার-হাজার কোটি টাকার সমুদ্র যে চুরি হয়েছে, তা অস্বীকার করতে পারেননি কেউই। কেউ কেউ আবার জোরগলায় সিন্ডিকেটের পক্ষে, মানে কার্যত দুর্নীতির পক্ষে সওয়াল করছেন!
ভারতে দুর্নীতি, বলা ভাল বিগ টিকিট দুর্নীতি, বিশ্বায়নের অনুষঙ্গ হিসেবে, আসে নব্বইয়ের দশক থেকে। স্বাধীনতার পরে প্রথম চার দশক হাতে গোনা দশটা বড় দুর্নীতির ঘটনাও ঘটেনি, এবং ঘটলেও তার মূল্য ছিল আজকের হিসেবে সব মিলিয়ে একশো কোটির কম, সেখানে বফর্স ও তার পর নব্বইয়ের দশক থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। তহলকার কল্যাণে বিজেপি প্রধান বঙ্গারু লক্ষ্মণকে লুকোনো ক্যামেরার সামনে ঘুষ খেতে দেখা যায়। সে সময়, এবং তার পরেও অনেক দিন অবধি অন্য প্রদেশের বন্ধুবান্ধবদের মজা করে বলতে শুনেছি যে, ‘বাঙালির বড় ঘুষ খাওয়ার কলজে নেই, বাঙালির দৌড় বড় জোর রাস্তায় দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশের দশ টাকা আর কর্পোরেশনের বাবুদের কয়েকশো টাকা খাওয়াতেই সীমিত।’
সত্যিটাও এর কাছাকাছিই ছিল। এক বিশিষ্ট বাঙালি প্রযুক্তিবিদের কাছে শোনা, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বিধাননগরে তাঁদের একটি দশ কোটি টাকার প্রকল্প করতে মাত্র সাড়ে তিন হাজার টাকা পার্টিকে অনুদান দিতে হয়, তাও হাত জোড় করে সেই অনুদানের অনুরোধ এসেছিল অঞ্চলের দাপুটে নেতার কাছ থেকে। ‘দেখলাম দশ বছরের মধ্যে কী ভাবে গোটা অবস্থাটাই পালটে গেল, নেতারা পালটে গেলেন, পালটে গেল রেটও।’
আসলে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝির পর থেকে দুটি ঘটনা ঘটল। প্রথমত, দেরিতে হলেও, বিশ্বায়নের ধাক্কা লাগল বঙ্গেও, সঙ্গে এল কাট মানি, কমিশন, ইত্যাদি। প্রায় না চাইতেই লক্ষ্মীলাভের পথ প্রশস্ত হল রাজনীতিকদের। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য সব ব্যবসাকে নানা কারণে পিছনে ফেলে এ রাজ্যে সামনে চলে এল রিয়েল এস্টেট। আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং-এর ২০১৩ সালের এক সমীক্ষা জানাচ্ছে, পরিকাঠামো, বিশেষ করে রিয়েল এস্টেট-এর ব্যবসায় ঘুষের রমরমা অত্যধিক। কেন না, এই ব্যবসায় ঘুষের ফল পাওয়া যায় দ্রুত, এক হাত টাকা দেয়, অন্য হাতে চলে আসে নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানোর ছাড়পত্র। আর এখানেই খেলায় প্রবল থেকে প্রবলতর ভাবে ঢুকে পড়ছেন রাজনীতির নেতানেত্রীরা। অর্থনীতির ভাষায় ‘পলিটিকাল রেন্ট সিকিং’, অর্থাৎ নেতানেত্রীরা তাঁদের ক্ষমতা ‘ভাড়া’ দেন বেআইনি কাজ করতে আর কব্জি ডুবিয়ে বুঝে নেন টাকা বা অন্য কিছু।
প্রথম প্রথম এই লেনদেন হত খানিক আড়াল রেখে, ক্রমে খোলামেলা। এতটাই যে, যাঁরা নিয়ম মেনে নির্মাণ করেন তাঁদেরও একটা বড় বাজেট সরিয়ে রাখতে হয় তোলা দেওয়ার জন্য। দক্ষিণ কলকাতায় এক মহিলা কাউন্সিলরকে দিনের বেলায় শরীর-ভর্তি গয়না (আলমারিতে বোধহয় আর জায়গা ছিল না) পরে গালাগালি করতে শুনেছি: ঘুষের টাকা কেন সময়মত পৌঁছয়নি! এক বন্ধু ব্যবসায়ী সে দিন বলছিলেন, মাত্র পাঁচ লাখ টাকার জন্যে এ সব নেতারা ফেঁসে গেল! ঠিকই তো, দিল্লি বা অন্য নানা প্রদেশে হাজার কোটি টাকার কমে কথা হয় না, কয়েক লাখে বঙ্গসন্তানরা আটকে থাকবেন কেন?
এ দুঃখ বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না। বাঙালি এগোচ্ছে। দ্রুত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy