ফাইল চিত্র।
ধর্মতলার এক সমাবেশে মুকুল রায় ভাষণ দেওয়ার পর থেকে যেন গোলকধাঁধায় ঘুরছে গোটা রাজ্য। বিশ্ব বাংলা— এই শব্দবন্ধ এখন গোটা রাজ্যে সবচেয়ে গুরুতর চর্চার বিষয়। কিন্তু বিস্ময়কর হল এই যে, প্রভূত চর্চা সত্ত্বেও এ বিতর্কের কোনও কূল-কিনারা দেখা যাচ্ছে না। কেন এই বিতর্ক চলছে, এ বিতর্কের উপসংহারে পৌঁছে কী মিলবে, যত দিন এ বিতর্ক ছিল না, তত দিনই বা বাংলা ও বাঙালির কী লাভ হচ্ছিল— সে প্রশ্নেরও কোনও উত্তর মিলছে না।
আরও পড়ুন: বিশ্ব বাংলা আমার সৃষ্টি, বললেন মমতা
যে নাম ও নকশা নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ‘বিশ্ব বাংলা’কে যখন প্রথম প্রকাশ্যে আনা হয়েছিল, তখনও এর তাৎপর্য বা গুরুত্বের খুব স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। বেষ্টনী বা বলয়ের মাঝে পৃথিবীর মানচিত্র, সে মানচিত্রে উদ্ভাসিত অবস্থান বাংলার— লোগোর এই নকশা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই সাধারণের মনে হয়েছিল, বিশ্ব মঞ্চে বাংলাকে তুলে ধরার নতুন কোনও এক প্রয়াস এটি। হঠাৎ কার পরামর্শে এবং পরিকল্পনায় এমন প্রয়াস, এ প্রয়াস কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে নিয়ে প্রশ্ন হয়ত উঁকি দিয়েছিল কারও কারও মনে। কিন্তু সামনে এসে জবাব চাওয়ার কেউ ছিলেন না। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধোঁয়াশা কাটিয়ে দেওয়ার তাগিদও কেউ দেখাননি। তাগিদটা ছিল চমক দেওয়ার। ফুটবল যুব বিশ্বকাপের বেশ কয়েকটি ম্যাচ আয়োজিত হল কলকাতায়। গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন। হোর্ডিঙে-ব্যানারে-ফ্লেক্সে মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেল বিশ্ব বাংলা এবং বিশ্বকাপ। রাজ্য সরকারের ফলাও প্রচার— বিশ্ব বাংলায় বিশ্বকাপ, এ বার খেলা জমবে বাংলা।
যুব বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল পশ্চিমবঙ্গ, এমন নয়। আয়োজক ছিল ভারত। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ম্যাচ। ফুটবলের এমন আন্তর্জাতিক আসরের গায়ে কী ভাবে শুধু বিশ্ব বাংলা ছাপ লাগিয়ে দেওয়া যায়, অনেক শিবির থেকেই তোলা হয়েছিল সে প্রশ্ন। তবে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সে বিতর্কের মুখেও অবিচল এবং নির্লিপ্ত থাকতে সফল হয় প্রশাসন।
এর পর আরও চমকে যাওয়ার পালা। শোনা গেল বিশ্ব বাংলার নাকি একটি মালিকানাও রয়েছে। তার সব স্বত্ব নাকি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে সংরক্ষিত। মুকুল রায়ই এ কথা প্রথম জানালেন। আর জানাতেই যেন তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল একখানা। লোক-লস্কর, সেপাই-পেয়াদা, মন্ত্রী-সান্ত্রী, উকিল-মোক্তার— সবাই মিলে যেন তুমুল ছোটাছুটি শুরু করে দিলেন। তৃণমূল বলল, মুকুল রায় মিথ্যা বলছেন। স্বরাষ্ট্রসচিব বললেন, মালিকানা সংক্রান্ত কথাবার্তা ভিত্তিহীন। ক’দিনের মধ্যেই জানা গেল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্ব বাংলার স্বত্বাধিকার ছাড়তে চেয়েছেন। শোনা গেল, রাজ্যও ওই লোগো নিজের নামে করার তাগিদে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মুকুল রায় কাগজপত্র দেখিয়ে দাবি করলেন, তাঁর বক্তব্যে সত্যতাই প্রমাণিত হচ্ছে, কারণ তিনি বিশ্ব বাংলা সংক্রান্ত ‘সত্য’ প্রকাশ্যে আনার পরই রাজ্য সরকার এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তরফে তড়িঘড়ি ওই লোগোর মালিকানা হস্তান্তরের চেষ্টা শুরু হয়েছে। সরকারের তরফে বোঝানোর চেষ্টা হল, কারও ভাষণের প্রেক্ষিতে নয়, বিশ্ব বাংলা সংক্রান্ত আইনি প্রক্রিয়া অনেক আগেই শুরু করা হয়েছে। কোনটা সত্যিই আগে হয়েছে, কোনটা পরে, সে সবের দিন-ক্ষণ-তারিখ-তিথি এবার গুলিয়ে যেতে শুরু করল। অভিষেক মানহানির মামলা করলেন। চাপানউতোর চলতেই থাকল।
ঘটনাপ্রবাহে সর্বশেষ সংযোজন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ খোলা। বিশ্ব বাংলা নিয়ে এক কাণ্ড হয়ে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, বিশ্ব বাংলা রাজ্য সরকারেরও নয়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরও নয়, বিশ্ব বাংলা তাঁর নিজের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানালেন, বিশ্ব বাংলা নাম ও লোগো তাঁর তৈরি এবং তাঁরই মালিকানাধীন। বিশ্ব বাংলা তাঁর স্বপ্ন। রাজ্য সরকারকে তিনি নিখরচায় ব্যবহার করতে দিয়েছেন এই লোগো। যতদিন রাজ্য চাইবে, ততদিনই এই লোগো ব্যবহার করতে পারবে। যখন চাইবে না, তখন লোগোটি তাঁর কাছে ফিরে যাবে।
এ আবার কী ধরনের বন্দোবস্ত? এর অর্থই বা কী? প্রথমত, এ কথাই কারও স্পষ্ট করে জানা নেই, বিশ্ব বাংলা আসলে কী বস্তু। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, তার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে। এক ব্যক্তি আচমকা একটা নকশা তৈরি করলেন। রাজ্য সরকারকে তিনি তা নিখরচায় ব্যবহার করতে দিলেন। সে নকশার তাৎপর্য না জেনেই নানা সরকারি কর্মসূচিতে ওই নকশার ছাপ লাগিয়ে দেওয়া শুরু হল। সরকার যদি কখনও এই লোগো ব্যবহার করতে না চায়, তাহলে তা ওই ব্যক্তির কাছেই ফিরে যাবে বলে জানানো হল। কোন আইনে, কোন কানুনে, কোন উপায়ে এমনটা সম্ভব হয়, তা কারও জানা নেই। কারও ইচ্ছা হলে তিনি যে কোনও ধরনের লোগো তৈরি করতেই পারেন। কিন্তু তিনি সে লোগো রাজ্য সরকারকে ব্যবহার করতে বলবেন কেন? সরকারই বা সে প্রস্তাব গ্রহণ করবে কেন? এই লোগো ব্যবহার করে সরকারের কী সুবিধা হচ্ছে এবং রাজ্যবাসী ঠিক কী ভাবে উপকৃত হচ্ছেন? একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠে গিয়েছে নতুন করে। অবশ্য আগের প্রশ্নগুলোর জবাব এখনও মেলেনি।
এত রহস্যাবৃত লোগো আগে কেউ দেখেছেন কোথাও? স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আপ্রাণ হাতড়েও এমন ঘটনাপ্রবাহের আরও একটি উদাহরণ খুঁজে আনা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাজ্যবাসী অতএব সেই গোলকধাঁধাতেই ঘুরপাক খাচ্ছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy