ধরাশায়ী বিজেপি নেতারা সম্ভবত বুঝিতেছেন, কৃষকদের বিক্ষোভগুলি নেহাত ‘রাজনৈতিক নাটক’ ছিল না। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তীসগঢ়ে তাঁহাদের ব্যর্থতার বিপরীত দিকে তেলঙ্গানায় চন্দ্রশেখর রাওয়ের সাফল্য বলিতেছে, ভারতের ভোট এখনও গ্রাম, কৃষকের খেত ঘুরিয়াই আসে। ব্যর্থতার দায় রাজ্যগুলির যতখানি, কেন্দ্রীয় সরকারের দায় তাহার তুলনায় কম নহে। গত সাড়ে চার বৎসরে নরেন্দ্র মোদী কৃষিক্ষেত্রের আয়বৃদ্ধি বিষয়ে, দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব বিষয়ে, গ্রামীণ ভারতের গুরুত্ব বিষয়ে যত কথা বলিয়াছেন, তাহার সিংহভাগই কথার কথা। পাঁচ বৎসরে কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করিয়া দেওয়াই যেমন। সাধারণ কৃষক হয়তো চক্রবৃদ্ধি হারের অঙ্ক কষিতে জানেন না, হয়তো জানেন না যে পাঁচ বৎসরে আয় দ্বিগুণ করিতে হইলে আয়বৃদ্ধির বাৎসরিক হার প্রায় ১৪ শতাংশ হওয়া প্রয়োজন— কিন্তু তিনি এটুকু জানেন, শুধু মুখের কথায় আয় বাড়ে না। পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফল বহুলাংশে গ্রাম-ভারতের অবিশ্বাসের প্রতিফলন। মন্দিরের হুঙ্কারে, ধর্মীয় মেরুকরণের অ-সভ্যতায়, সিয়াচেনের সৈনিকদের দোহাইয়ে— কিছুতেই যে ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষকের মন ভিজিবে না, কোনও স্লোগানই যে তাঁহার ভাতের হাঁড়িতে দুই মুষ্টি চাল ফেলিবে না, এই কথাটি নেতারা যত দ্রুত বোঝেন, ততই মঙ্গল।
কিন্তু, সেই বোঝার একটি বিপদ আছে। কংগ্রেস যেমন কৃষকের ক্ষোভ আঁচ করিয়া তাহাদের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতির বান বহাইয়া দিয়াছে। ছত্তীসগঢ়ে প্রতিশ্রুতি, সরকার গঠনের দশ দিনের মধ্যে কৃষকের ঋণ মকুব করা হইবে। প্রতিশ্রুতির সহিত বাস্তবের ফারাক চির দিনই দুস্তর— ‘সব কৃষক’ বলিতে ঠিক কাহাদের বোঝায়, তাহা নির্ধারণে ভারতীয় রাজনীতির প্রতিভা অবিস্মরণীয়। কিন্তু, ২০১৯ দরজায় কড়া নাড়িতেছে। পঞ্জাব বা মহারাষ্ট্রে যে ভাবে কৃষিঋণ মকুবের যোগ্যতামান ধার্য করা হইয়াছিল, লোকসভা ভোটের মুখে ছত্তীসগঢ়ে তাহা করা বিপদ। আরও মুশকিল ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ঊর্ধ্বে ফসল কিনিবার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা। শুধু ধানের ক্ষেত্রেই যদি কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষিত এমএসপি-র অধিক প্রতি কুইন্টালে আরও ৭৫০ টাকা বাড়তি দিতে হয়, তাহাতে বৎসরে খরচ ৩৭৫০ কোটি টাকা। মধ্যপ্রদেশেও একই সমস্যায় পড়িবে কংগ্রেস। ভোটের মুখে কৃষকের মন রাখিতে সরকার যদি রাজকোষ উজাড় করিয়া দেয়, কোন মন্ত্রে সেই আর্থিক ধাক্কা সামলাইবে কংগ্রেস? কেন্দ্রীয় সরকার যদি ভোটের ভাঙন রুখিতে এই খয়রাতির খেলায় দ্বিগুণ উৎসাহে ঝাঁপাইয়া পড়ে, সেই টাকাই বা জোগাইবে কে?
এই সমস্যার কেন্দ্রে আছে একটি কু-অভ্যাস— টাকা দিয়া কৃষকের মুখ বন্ধ করাইবার প্রথা। ঋণ মকুবই হউক বা বাড়তি সহায়ক মূল্য, কোনওটিই কৃষির মূলগত সমস্যার সমাধান করিতে পারে না। তাহা বিপন্ন কৃষককে সাময়িক রেহাই দেয় মাত্র। পরের মরসুমে কৃষক ফের বিপন্ন হইবেন। ভারতীয় কৃষিতে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। কৃষক যাহাতে বাজারের নাগাল পান, তাঁহার নিকট যাহাতে সস্তা ঋণ পৌঁছায়, ফসল নষ্ট হইলে তাঁহার জন্য যেন বিমার সুরক্ষা থাকে, তাঁহার খেতে যেন সেচের জল পৌঁছায়— এইগুলি নিশ্চিত না করিতে পারিলে কৃষির সমস্যা মিটিবার নহে। মুশকিল হইল, প্রতিটি কাজই দীর্ঘমেয়াদি। ভোটের মুখে টনক নড়িলে তাহার কোনওটিই করিয়া উঠা যায় না। তেলঙ্গানায় টিআরএস-এর সাফল্য হইতে কংগ্রেস ও বিজেপি শিখিতে পারে, কী ভাবে একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব। সেই রাজ্যেও সরকার কৃষকদের টাকা দেয়, কিন্তু তাহা চাষের মরসুম শুরু হইবার পূর্বে। যাহাতে কৃষকদের ঋণের ফাঁদে পড়িতেই না হয়। এই মডেলটি লইয়াও সমস্যা আছে। কিন্তু, ঋণমকুবের খয়রাতির তুলনায় তাহা ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy