এই জয় আনন্দের, কিন্তু উদ্বেগ হইতে এই মুক্তি ততোধিক আনন্দের— গুজরাতে নির্বাচনী ফলের পর বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব নির্ঘাত এই কথাটিই ভাবিতেছেন। জয় আসিয়াছে, কিন্তু সহজে আসে নাই। বাইশ বৎসর একাদিক্রমে গুজরাতের শাসনশীর্ষে থাকিবার পর বিজেপি আবারও ফিরিতে পারিবে কি না, তাহা লইয়া এক রাশ আশঙ্কা ও সংশয় পার হইয়া আসিয়াছে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল বলিতেছে, গত বিধানসভার তুলনায় বিজেপির ভোট শতাংশ কমে নাই, বরং ঈষৎ বাড়িয়াছে। আসনসংখ্যা কমিলেও শহর-নগরে বিজেপির বিজয় বিরাটতর হইয়াছে। বাইশ বৎসর ধরিয়া কোনও দল রাজ্য শাসন করিলে স্থিতাবস্থা-বিরোধিতার স্রোতটি জোরালো হইবারই কথা। ভোটের আগে সেই স্রোতের টান কিছু পরিমাণে অনুভূতও হইয়াছিল। তবু শেষ রক্ষা হইয়াছে। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বার্থ রাজনীতি ও আইডেন্টিটি বা পরিচিতির রাজনীতি বিভিন্ন রকম হইলেও প্রায় সর্বত্রই একটি স্পষ্ট ধারা দেখা গিয়াছে: মোট হিসাবে বিজেপির ভোট প্রতি অঞ্চলে বাড়িয়াছে। সামষ্টিক বিচারে রাজ্যের মানুষ বিজেপি হইতে মুখ ফিরান নাই: সাক্ষাৎ প্রমাণ মিলিয়াছে।
প্রশ্ন হইল: ভোট শতাংশ এক থাকিলেও আসনসংখ্যা তো কমিয়াছে। তাহা ছাড়া, ভোটের ফল যাহাই হউক, কেষ্ট যে অতি কষ্টে অর্জিত হইয়াছে, তাহাও ভুলিবার নয়। সুতরাং বিজেপির এক উদ্বেগ গেলেও অন্য উদ্বেগ রহিয়াই গেল। বেশ কিছু আসনে কান-ঘেঁষা ব্যবধানে জয় হজম করিতে হইয়াছে, কিছু ক্ষেত্রে ভোটজমি বিরোধীকে ছাড়িয়া দিতে হইয়াছে। ভূমিপুত্র প্রধানমন্ত্রী গর্বিত হইতে পারেন, দুই আঙুলের ভি অনবরত ক্যামেরার সামনে প্রদর্শন করিতে পারেন। কিন্তু গর্ব ও স্বপ্নের ফাঁকে ফাঁকে তাঁহাকে ভাবিতেই হইবে, কেন প্রধানমন্ত্রীর আপন রাজ্যে শাসক দলকে এতখানি উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা পার হইতে হইল। বাইশ বৎসর পর প্রধান বিরোধী দলের অপেক্ষা আট শতাংশ ভোট বেশি পাইয়া ফিরিয়া আসা নিশ্চয়ই প্রীতিদায়ক অভিজ্ঞতা, কিন্তু কেন সেই সুযোগে বিরোধী দলও রাজ্যে অনুষ্ঠিত শেষ বড় মাপের নির্বাচন অপেক্ষা নিজেদের ভোট আট শতাংশ বাড়াইয়া ফেলিতে পারিল। কেন শহরাঞ্চলে ভোট ব্যবধান যথেষ্ট হইলেও গ্রামাঞ্চলে পরাজয়ের স্বাদ বেশি হইল। বিকাশপুরুষ পরিচয়ে ঋদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর বিকাশ-কাহিনিটি কেন ততখানি ভোট-জাদু তৈরি করিতে পারিল না।
এই সব বিবিধ প্রশ্নের সহিত বিজেপির এ বারের গুজরাত-জয়ের সংবাদটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভোলা কঠিন হইবে, এই নির্বাচনই রাহুল গাঁধীর সত্যকারের উদয়-মুহূর্ত। মাত্র উনিশটি আসন পিছনে থাকা বিরোধী দলের সম্মান পাইয়া কংগ্রেস গুজরাতে নূতন রাজনৈতিক যাত্রা আরম্ভের সুযোগ পাইল। সেই সুযোগ তাহারা ও তাহাদের নূতন তরুণ তারকা নেতা কত ভাল ভাবে ব্যবহার করিতে পারিবেন, তাহা আলাদা কথা। কিন্তু শাসক দলের বিরুদ্ধে গুজরাতি সমাজের একাংশের ক্ষোভের কারণেই তো এই সুযোগটি সৃষ্ট হইল। আর কেবল রাহুল গাঁধী কেন! এই ভোট ভারতীয় রাজনীতিতে হার্দিক পটেল-এর মতো পাতিদার নেতা কিংবা জিগ্নেশ মেবাণীর মতো দলিত নেতাকেও তারকার মহিমা আনিয়া দিল— বিজেপির বিরুদ্ধ অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করিল। কংগ্রেস ও অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী জোট বাঁধিলে বিজেপির স্বস্তি উড়িয়া যাইতে পারে, বুঝাইয়া দিয়াছে। মোট কথা, বিজয়ী বিজেপি কিংবা পরাজিত কংগ্রেস, উভয়ের কাছেই গুজরাত ভোটের বার্তাসমূহ অতি গুরুতর। ২০১৮ সালে পা রাখিবার অর্থই জাতীয় নির্বাচনের দরজায় আবার টোকা পড়া। গুজরাতের বার্তা তাই সময় থাকিতে সকল পক্ষেরই পড়িয়া শুনিয়া লওয়া জরুরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy