মা-বাবাকে ছেড়ে গেল অগ্নিদগ্ধ শিশু দিয়া দাস। হয়তো এটা অবধারিত ছিল— শরীরের এতটা অংশ পুড়লে বাঁচা শক্ত। একটা দ্বিধা তবু রয়ে গেল। আর, যেটা অবধারিত নয়, তা হল বিশ-বাইশ ঘণ্টা সাত হাসপাতালে ধর্না, তত ক্ষণ কার্যত বিনা চিকিৎসায় যন্ত্রণা আর্তনাদ, মা-বাবার হয়রানি ও মানসিক বিপর্যয়, তিন জনেরই নাগরিক ও মানবিক অপমান।
এমন অপমান সাধারণ মানুষ নিত্য নীরবে ভোগ করেন; এ ঘটনা প্রচার পেল মর্মান্তিক নাটকীয় পরিণতির জন্য, ও স্বাস্থ্য বিভাগের দুই বড় কর্তার উক্তির ফলে। এক জন বলেছেন (অতীতে এক ভয়ঙ্কর ঘটনার পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিধ্বনি করে), এমন তো কতই ঘটে। অন্য জনের প্রতিক্রিয়া আরও সময়োপযোগী ও ইতিবাচক: সরকারের বদান্যতার দরুন নিখরচায় চিকিৎসা পেতে হাসপাতালে ভিড় বেড়েছে, একটু ধৈর্য ধরা চাই।
হক কথা। সাতাশ নয় সাতটা হাসপাতাল, পরিক্রমায় চব্বিশ ঘণ্টাও কাটেনি, নেতা-মন্ত্রী-আমলা নয়, নেহাত এক বাচ্চা মেয়ে, না-হয় নিজেরই সন্তান, তাতেই এত ছটফট? ভগবান না করুন, আধিকারিক মহাশয়ের আদরের কোনও শিশুর এমন বিপদ ঘটলে নিশ্চয় তিনি সংযমের আদর্শ স্থাপন করতেন। তবু বলি, ভদ্রলোক বাংলার জনগণের প্রতি অবিচার করলেন। ধৈর্য তাঁদের সত্যিই অসীম। ভাবুন সেই মেয়েটির কথা, পথ দুর্ঘটনার পর যে এসএসকেএমে ভর্তি ছিল। সংগ্রহ হয়েছিল বিরল গ্রুপের রক্ত; চব্বিশ ঘণ্টায় সেটা শরীরে না ঢোকানোয় মেয়েটি মারা যায়। তদন্ত হয়েছিল, দোষীরা শনাক্ত হয়েছিল, আজও শাস্তিদান হয়নি। মেয়েটির আপনজনের ধৈর্য প্রশ্নাতীত। সব অর্থেই তাঁরা আদর্শ ‘পেশেন্ট’ পার্টি।
ভাবুন সেই বিশিষ্ট সরকারি চিকিৎসকদের কথা, বিচিত্র কারণে যাঁদের বছরের পর বছর বসিয়ে রাখা হয়েছে, অন্যত্র চলেও গিয়েছেন কেউ-কেউ। এঁরা কৃতী ও সফল, দুর্দিনেও অসহায় নন, তাঁদের হয়ে ওকালতি করা ধৃষ্টতা। কিন্তু ভাবতে হয় সেই দরিদ্র রোগীদের কথা, এঁদের চিকিৎসা থেকে যাঁরা এত দিন বঞ্চিত হলেন। উপরন্তু থমকে গেল কিছু উন্নয়নের সম্ভাবনা, অন্তত একটি ক্ষেত্রে ফিরে গেল দরাজ বিদেশি সাহায্য। ধরে নিলাম এই ডাক্তাররা অত্যন্ত বদ লোক, তাঁদের কঠোর সাজা প্রাপ্য; তাতেই বা দেরি কেন? ছ’সাত বছরে সাসপেনশন কেসের নিষ্পত্তি হয় না এ কেমন প্রশাসন?
তিতিক্ষা শব্দটা কাব্যিক, কিন্তু গদ্যময় বাস্তবে ওটাই জনজীবনের ডিফল্ট মোড। আবহমানকাল ধরে দেখছি, মুমূর্ষু রোগী বেডের সন্ধানে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল ছুটছে; শুনে আসছি, কেন্দ্রীয় ভাবে সব খালি বেডের হিসাব রাখার ও রোগীকে সেই ভাবে নির্দিষ্ট করার প্রতিশ্রুতি। প্রযুক্তির দিক দিয়ে কাজটা জলভাত, কিন্তু আজও হল কই? বেবন্দোবস্তের খবর নিয়মিত উঠে আসে: কোথাও ডাক্তার আছে তো যন্ত্র নেই, কোথাও বহুমূল্য যন্ত্র পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। ব্যক্তি-রোগীর যন্ত্রণা না-হয় বড় কর্তাদের গোচরে আসার কথা নয়; কিন্তু পরিকল্পনা ও পরিচালনার এই ব্যাপক সমস্যাগুলি?
মানতে হবে, রাজ্যে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সাম্প্রতিক অনেক বৃদ্ধি এমনকি শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। এটা স্বাগত, কারণ সারা দেশে গরিবের চিকিৎসা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে বেসরকারি বিমা ও হাসপাতালের বৃহৎ পুঁজির জঠরে। বাংলার অনেক সাধারণ মানুষ কিন্তু বলছেন অন্তত কিছু হাসপাতালের উন্নত পরিবেশ, উন্নত পরিষেবার কথা। চিরকাল তাঁরা এত কম পেয়ে এসেছেন যে এতেই খুশি, গুরুতর বিপর্যয় না ঘটলে নালিশ করেন না। ঘটলে কিন্তু হাসপাতাল ভাঙচুর, ডাক্তার নিগ্রহ ছাড়া অন্য পন্থার হদিস পান না; কর্তাদেরও অবলম্বন যেন এই নিদারুণ সেফটি ভালভ, স্থায়ী সমাধান এমনকি অনাচার নিয়ন্ত্রণ নয়। ফলে ব্যাপক উন্নয়ন পর্যবসিত হচ্ছে ছোটবড় একরাশ বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের আধাখেঁচড়া যোগফলে, বিয়োগও ঘটছে মাঝে-মাঝে; সংহত ভাবে পুরো ব্যবস্থাটার গুণগত রূপান্তর ঘটছে না।
অর্থাৎ জনমুখী সরকারের সঙ্গে জনগণের আত্মিকতায় একটা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনার উৎসে যে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা, সেটা হুজুগ, রাজনীতি ও সুযোগসন্ধানীর ব্যূহ ভেদ করে সার্থক হয়ে ওঠেনি, লাগেনি সুষ্ঠু অবাধ পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। দক্ষ প্রশিক্ষিত কর্মীরা যে কারণেই হোক সুযোগ বা ভরসা পাচ্ছেন না, যোগই দিচ্ছেন না তেমন। কেবল স্বাস্থ্যক্ষেত্রে নয়, সর্বত্র, সর্বোপরি শিক্ষাক্ষেত্রে, মনোবলের অভাব, ফলে মানবসম্পদের অপচয়, দিন দিন প্রকট হচ্ছে। উচ্চ মেধার রত্নভাণ্ডার এমন দুরবস্থায়, আমরা নির্বিকার।
সুষ্ঠু কর্মকাণ্ডের এক অলঙ্ঘ্য শর্ত হল কর্মীদের পেশাগত আত্মমর্যাদা, যার দরুন, সজ্জনদের কথাই নেই, দুর্জনেরাও কিছু শর্ত মেনে চলেন, কতকগুলো আপস করেন না নিজের কাছেই অগ্রহণীয় ঠেকবে বলে, পেশার উপর ঘেন্না ধরে যাবে বলে। নচেৎ কোনও-না-কোনও যুক্তিতে সব অপকর্মই আমরা দস্তুর বলে মানব, কর্মী হিসাবে জাতিচ্যুত হব; কাজ এগোবে এলোমেলো পথে গোঁজামিল দিয়ে, দড়ি টেনে মোটরগাড়ি চালানোর মতো। শেষ অবধি স্থির বিশ্বাস দাঁড়াবে, এটাই যন্ত্রের স্বাভাবিক চালিকাশক্তি।
অধিকাংশ প্রশাসক আজ বিশ্বাস করেন, সত্যিই করেন, রাজনৈতিক প্রভুদের আজ্ঞাপালন তাঁদের শুধু ভবিতব্য নয়, কর্তব্য। এই শর্টকাট রাস্তায় তাঁরা আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পান ও আত্মোন্নতি সুনিশ্চিত করেন। কেবল তাঁরা কেন, সারা সমাজ যে এই অপনীতি নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে, রাজনীতিক শ্রেণির এটাই চূড়ান্ত সাফল্য। কোনও সৎ নীতি বা প্রকল্প যদি বা তাঁরা গ্রহণ করেন, তারও রূপায়ণ অতএব দুষ্ট হয়ে পড়ে।
কর্মিকুলের কিছু প্রহ্লাদ এই শর্তে কাজ করা শুধু অসম্মানজনক নয়, অসম্ভব মনে করেন। এটা বেশি ঘটে কৃতী ও সফল পেশাদারদের মধ্যে, কারণ সাফল্যের সূত্রই হল বাহ্য অপ্রাসঙ্গিক বিষয় অগ্রাহ্য করে কাজের জন্য কাজ করা। এমন কর্মীরা বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজেন না, আর— কখনও বলছি না, কারণ সকলেই রক্তমাংসের মানুষ— সহজে চাপ বা প্রলোভনের শিকার হন না।
গণতন্ত্রের পাঠ্যপুস্তক মেনে জনহিতই যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস হত, রাষ্ট্রের কাজে এই কর্মীদের সবার আগে ডাক পড়ত, সমাদর হত। পরিবর্তে শাসককুল যত বেশি করে অন্য স্থূল সহজ পথে ক্ষমতা সুনিশ্চিত করেন, এই কাজের লোকগুলি হয়ে যান অবান্তর, কখনও-বা উপদ্রব বা রীতিমতো বিপদ। এক-আধ জনকে সরিয়ে দিতে হয়, বাকিরা এমনিতেই এলেবেলে হয়ে পড়েন। পরিবর্তে আসেন অপর এক গোষ্ঠী, যার কেউ-কেউ হয়তো প্রথম দলের মতোই কর্মঠ; তাঁরাও এখন অযোগ্য ও সুযোগসন্ধানীর সঙ্গে গা মেলান অন্য চরিত্রের এক শাসনব্যবস্থায়, যার মূলমন্ত্র কাজের তাগিদে ক্ষমতা নয়, ক্ষমতার তাগিদে কাজ। এমন কর্মকাণ্ডে ভেজাল মিশতে বাধ্য। ফলে কর্মিবাহিনীর কীর্তিতেই নেতারা বিপন্ন হন, বিপন্ন হয় জনগণের বৃহত্তর স্বার্থ। এমন সহযোগী থাকতে শত্রুর দরকার কী?
একটা কথা না ভাবলেই নয়। এক ভীতিপ্রদ আগ্রাসী ভাবধারা ভারত জুড়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। বিদ্বেষ-বিভাজন, ‘উত্তর-সত্যের’ চর্চা, অসার প্রতিশ্রুতি ও ততোধিক অসার বাক্যস্রোতের পাশাপাশি তার আর এক প্রকাশ অসাম্যের বৃদ্ধি ও দরিদ্রের বঞ্চনায়। প্রতিরোধের শ্রেষ্ঠ উপায় এক বিকল্প জনহিতকর শাসনধর্ম মানুষের সামনে তুলে ধরা। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পূর্বতন শাসকদের ‘বিকল্প অর্থনীতি’তে কিছু মূল্যবান চিন্তা ছিল, ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে একটা বৈপ্লবিক সূচনাও হয়েছিল; তার পর তুলনীয় কিছু হয়নি, মানুষের প্রত্যাশা মেটেনি। বর্তমান মডেলটি নজর কেড়েছে নানা দ্রুত প্রত্যক্ষ দান-অনুদান ও পরিষেবার কারণে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষ হাতে-হাতে উপকার পাচ্ছেন, কিছু ব্যাপক সুফলের আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চিন্তা ও পরিকল্পনার ভিত প্রায়ই নড়বড়ে, জনহিতকর নয়, জনমোহিনী। অশুভ সঙ্গত করছে দাদাগিরি আর তোলাবাজির পাঁচালি। আর এই ব্যবস্থা সরাসরি কার্যকর করবেন যে শাসককুল, তাঁরা পড়ে আছেন (ব্যক্তিবিশেষ নিশ্চয় ব্যতিক্রম) নির্লিপ্ত অসহায়তা আর সিনিকাল সুযোগসন্ধানের মধ্যভূমিতে।
এমন অবস্থায় দু’টি পন্থা সম্ভব। এক হল গলা বাজিয়ে বলা, সব ঠিক হ্যায়, যাঁরা অন্যরকম ভাবেন তাঁরা গণশত্রু। এই কৌশলের বিপদ হল, যে শিবিরের বাস্তব কাজের খতিয়ান দেওয়ার তাগিদ নেই, বিস্ফোরক বাণী আর গা-জোয়ারি আলোড়নই যাঁদের অবলম্বন, তাঁদের অভ্যস্ত হাতিয়ারে তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে নামলে জয় অনিশ্চিত।
অপর বিকল্প: যে জন্য, যাঁদের জন্য একটা বৃহৎ কর্মসূচির পথ এত আঁকাবাঁকা অমসৃণ, তাঁদের দূর করার কিছু আন্তরিক প্রচেষ্টা। কাজটা অপ্রিয় ও অস্বস্তিকর। কখনও-বা ত্রুটিস্বীকার করতে হবে, পিছু হটতে হবে, বশংবদ অনুগামীদের হতাশ করতে হবে, আস্থা রাখতে হবে এমন লোকেদের উপর যাঁরা আনুগত্যে অপারগ, কিন্তু সম্মানজনক শর্তে সাধু উদ্দেশ্যে কাজ করতে একাগ্র।
সাধারণ্যের আস্থা এ ভাবে সুনিশ্চিত না করলে টালমাটাল দেশে আজ না হোক কাল ক্ষমতা বাঁচানো দায় হবে, সেই সঙ্গে মিলিয়ে যাবে মানুষের কিছু যথার্থ মঙ্গলের সম্ভাবনা। ক্ষমতার কথা না-হয় ক্ষমতার পূজারিরা ভাববেন; জনকল্যাণে তো সকলের স্বার্থ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy